প্রজনন প্রক্রিয়ায় জীব নিজ সত্তাবিশিষ্ট অপত্য বংশধর সৃষ্টি করে নিজ প্রজাতির স্থায়িত্ব বজায় রাখে। মানুষের বংশবৃদ্ধি যৌন জনন প্রক্রিয়ায় সাধিত হয়।
পুরুষ প্রজননতন্ত্র (Male Reproductive System):
মানুষে শুক্রাণু উৎপাদন, সঞ্চয় ও পরিবহন কাজের ভিত্তিতে পুরুষ জননতন্ত্রকে দুভাবে ভাগ করা যায়ঃ মুখ্য (primary) ও আনুষঙ্গিক (accessory)। যে অঙ্গ শুক্রাণু উৎপন্ন করে তাকে মুখ্য জনন অঙ্গ; এবং যে সব অঙ্গ শুক্রাণু সঞ্চয় ও পরিবহনের কাজে নিয়োজিত সেগুলোকে আনুষঙ্গিক জনন অঙ্গ বলে।
শুক্রাশয় হচ্ছে মুখ্য জননাঙ্গ।
১. শুক্রাশয় (Testes): একজোড়া ডিম্বাকার শুক্রাশয় ক্রোটাম (scrotum) নামক একটি থলির ভিতর আবদ্ধ এবং শুক্ররজ্জু দিয়ে লাগানো অবস্থায় দু’পায়ের উরুসন্ধিতে উপাঙ্গের মতো ঝুলে থাকে। প্রত্যেক শুক্রাশয়ের ভিতরে প্রায় ১০০০টি সূক্ষ্ম ও প্যাচানো সেমিনিফেরাস নালিকা (seminiferous tubules) থাকে। এসব নালিকা কতকগুলো সংগ্রাহক নালিকায় উন্মুক্ত হয়ে এক জালিকাকার গঠন সৃষ্টি করে, একে রেটি টেসটিস (rete testis) বলে । রেটি টেসটিস থেকে প্রায় বিশটি ৪-৬ মিলিমিটার লম্বা সংগ্রাহক নালি সৃষ্টি হয়ে প্রত্যেক শুক্রাশয়ের শীর্ষদেশ থেকে শুক্রাশয় ত্যাগ করে এপিডিডাইমিসে মিলিত হয়। সংগ্রাহক নালিগুলোকে ভাসা ইফারেন্সিয়া (vasa efferentia) বলে।
কাজ: শুক্রাণু-মাতৃকোষ শুক্রাণু উৎপন্ন করে এবং টেস্টোস্টেরন নামক হরমোন ক্ষরণ করে।
২. এপিডিডাইমিস (Epididymis): প্রত্যেক শুক্রাশয়ের ভাসা ইফারেন্সিয়া একত্রে মিলিত হয়ে একটি করে ৪-৬ মিটার লম্বা অত্যন্ত প্যাচানো এপিডিডাইমিস গঠন করে।
কাজ: শুক্রাণুর নিষেক ক্ষমতা বাড়ায় এবং পুষ্টি পদার্থ ক্ষরণ করে এগুলোকে সতেজ রাখে।
৩. ভাস ডিফারেন্স (Vas deferens) বা শুক্রনালি: প্রতিটি এপিডিডাইমিস প্রায় ৪০-৫০ সেন্টিমিটার লম্বা, বড় গহ্বর ও মোটা প্রাচীরবিশিষ্ট একেকটি ভাস ডিফারেন্স-এ উন্মুক্ত হয়। মূত্রনালি অতিক্রম করার পর অ্যাম্পুলা (ampulla) নামক একটি মাকু আকৃতির ফোলা অংশ গঠন করে। অ্যাপুলা পরে সেমিনাল ভেসিকলে যুক্ত হয়।
কাজ: প্রধান কাজ হচ্ছে সঙ্গমের সময় দ্রুত শুক্রাণু পরিবহন করা। তবে কিছু সময়ের জন্য শুক্রাণু জমাও রাখে।
পুরুষ প্রজননতন্ত্র (Male Reproductive System):
৪. সেমিনাল ভেসিকল (Seminal vesicle): সেমিনাল ভেসিকল হচ্ছে মূত্রথলির নিম্নপ্রান্ত ও মলাশয়ের মাঝখানে অবস্থিত একজোড়া ছোট, আঙ্গুলের মতো কোঁচানো থলিকা।
কাজ: বীর্য বা সিমেন (semen) উৎপন্নের জন্য ফ্রুক্টোজ সমৃদ্ধ বিপুল পরিমাণ পিচ্ছিল থকথকে পদার্থ ক্ষরণ করে। ক্ষরণের ফুক্টোজ সচল শুক্রাণুর শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে।
৫. ক্ষেপন নালি (Ejaculatory duct): প্রত্যেক সেমিনাল ভেসিকল থেকে সৃষ্ট একটি করে খাটো নালি প্রত্যেক ভাস ডিফারেন্সের সাথে একীভূত হয়ে ০.৩ মিলিমিটার ব্যাসের ১৯ মিলিমিটার লম্বা অভিন্ন ক্ষেপন নালি গঠন করে।
কাজ: সেমিনাল ভেসিকলের ক্ষরণসহ শুক্রাণুকে ইউরেথ্রায় পৌঁছে দেয়।
৬. ইউরেথ্রা (Urethra): এটি রেচনতন্ত্র ও প্রজননতন্ত্রের একটি অভিন্ন নালি যা প্রায় ২০ সেন্টিমিটার লম্বা এবং শিশ্নের শীর্ষদেশে উন্মুক্ত হয়।
কাজ: এ নালির মাধ্যমে বীর্য বাইরে স্খলিত হয় এবং মূত্র নিষ্কাশিত হয়।
৭. বহিঃযৌনাঙ্গ (External genitalia): এটি দুরকম, যথা- স্ক্রোটাম ও শিশ্ন।
ক. স্ক্রোটাম (scrotum) বা অন্ডথলি: এটি দুই উরুর মাঝখানে ঝুলে থাকা ও ত্বকে আবৃত থলি বিশেষ। ত্বকের নিচে পাঁচ ধরনের পেশিস্তর ক্রমান্বয়ে বিন্যস্ত থাকে।
কাজ: স্ক্রোটাম শুক্রাণু উৎপন্নের অনুকূল তাপমাত্রা রক্ষা করে। শুক্রাশয়কে চাপজনিত ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
খ. শিশ্ন (Penis) বা পুরুষাঙ্গ: শিশ্ন হচ্ছে পুরুষের এমন একটি বহিরাঙ্গ যার ভিতর দিয়ে ইউরেথা অতিক্রম করে বাইরে উন্মুক্ত হয়। এর ত্বকের নিচে চর্বি নেই কিন্তু পাতলা টিস্যু আছে। তাই শিশ্নের ত্বক এত আলগা। যে অংশ থেকে শিশ্ন উঠেছে তাকে শিশ্নমূল (root) বলে। শিশ্নের যে অংশ ঝুলে থাকে, সেটি শিশ্নদেহ। এর ডগায় ব্যাঙের ছাতা আকৃতির লাল মুন্ডিকে গ্লান্স পেনিস (glans penis) বলে। এতে সবচেয়ে বেশি স্নায়ুর প্রান্তদেশ উন্মুক্ত। এ মুন্ডিকে যে চামড়া ঢেকে রাখে, তাকে প্রীপিউস (prepuce) বলে (মুসলমান পুরুষে এ অংশটি খতনার সময় কেটে ফেলা হয়)। শিশ্নদেহ দুধরনের ইরেকটাইল (erectile) টিস্যুতে গঠিত:
(i) কর্পোরা ক্যাভারনোসা (corpora cavernosa) ও
(ii) কর্পোরা স্পঞ্জিওসাম (corpora spongiosum)। এ টিস্যু দৃঢ় হলে শিশ্ন প্রসারিত হয়।
কাজ: এটি ইউরেথার মাধ্যমে বীর্য স্ত্রী জননতন্ত্রের অভ্যন্তরে প্রেরণ করে।
৮. জনন গ্রন্থি: মানুষের জনননালি সংশ্লিষ্ট নিচে বর্ণিত দুটি গ্রন্থি পাওয়া যায়।
ক. প্রস্টেট গ্রন্থি (Prostate gland): এটি শ্রোণিগহ্বরে মূত্রথলির নিচে অবস্থিত নাশপাতি আকৃতির গ্রন্থি এবং গোড়া ও চূড়ায় বিভক্ত।
কাজ: এ গ্রন্থি থেকে একধরনের ক্ষারীয় তরল নিঃসৃত হয় যা বীর্যরসের পরিমাণ বৃদ্ধি করে এবং যোনির ভিতরের অম্লীয় অবস্থাকে প্রশমিত করে শুক্রাণুকে বেঁচে থাকতে সহায়তা করে।
খ. বাল্বোইউরেথ্রাল (Bulbo-urethral) বা কাওপার-এর গ্রন্থি (Cowper’s gland): এ গ্রন্থি হচ্ছে ইউরেথ্রার দুপাশে অবস্থিত দুটি মটর দানার মতো গ্রন্থি যা থেকে নালিকা বেরিয়ে ইউরেথ্রায় মিলিত হয়।
কাজ: সংগমের সময় এ গ্রন্থি মিউকাস (পিচ্ছিল পদার্থ) ক্ষরণ করে।
পুরুষ প্রজননতন্ত্রের হরমোনাল ক্রিয়া (Hormonal Action of Male Reproductive System):
পুরুষ প্রজননতন্ত্রের সাথে জড়িত বিভিন্ন হরমোন ও সেগুলোর কাজ নিচে উল্লেখ করা হলো−
১. শুক্রাশয়ের ইন্টারস্টিশিয়াল কোষ থেকে ক্ষরিত টেস্টোস্টেরন (testosterone) হরমোন মুখ্য ও আনুষঙ্গিক
জননাঙ্গের বৃদ্ধি ও বিকাশ এবং বিভিন্ন গৌণ (Secondary) যৌন বৈশিষ্ট্যের বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করে।
২. অগ্র পিটুইটারি গ্রন্থির সম্মুখ খণ্ড (lobe) থেকে ক্ষরিত ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন (Follicle Stimulatine hormone ) ও লুটিনাইজিং হরমোন (Luteinising Hormone-LII) এর প্রভাবে যৌন হরমোন টেস্টোস্টেরন ক্ষরিত হয়।
৩. পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত লুটিওট্রফিক হরমোন (Lucotrophic formoneLTH) গৌণ যৌন অঙ্গের বিকাশ ঘটায়।
৪. অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত গোনাডোকর্টিকয়েড (Gonadlocorticoids) হরমোন ভ্রণের যৌন বিভেদ নিয়ন্ত্রণ করে এবং যৌনগ্রন্থি, যৌনাঙ্গ ও গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটায়।
৫. শুক্রাশয় থেকে ক্ষরিত অ্যান্ড্রোস্টেরন (Androsterone) পুরুষের গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটায় এবং স্পার্মাটোজেনেসিস বা শুক্রাণুজননে শুক্রাশয়কে উদ্বুদ্ধ করে।
৬. শুক্রাশয়ের সারটলি কোষ (sertoli cell) থেকে ক্ষরিত ইনহিবিন (Inhibin) হরমোন শুক্রাণু উৎপন্নে সাহায্য করে।
স্ত্রী প্রজননতন্ত্র (Female Reporoductive System) :
১. ডিম্বাশয় (Ovary): শ্রোণির পিছনে ফাঁপা গহ্বরে জরায়ুর দুপাশে ইউরেটারের নিচে বাদাম আকৃতির একজোড়া ডিম্বাশয় অবস্থিত। জরায়ু ও ফেলোপিয়ান নালিসহ উদরে একটি পেরিটোনিয়াম পর্দার ভাঁজ করা টিস্যুর সাহায্যে আটকে থাকে।
কাজ: ডিম্বাণু উৎপন্ন করা ডিম্বাশয়ের প্রধান কাজ। তাছাড়া স্ত্রী যৌন হরমোন-ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন সংশেষ ও ক্ষরণ করে থাকে।
২. ডিম্বনালি বা ফেলোপিয়ান নালি (Fallopian tube): জরায়ুর দুপাশে দুটি পেশল ও ১২ সেন্টিমিটার লম্বা ডিম্বনালি অবস্থিত। ডিম্বাশয় সংলগ্ন প্রান্তটি অসংখ্য আঙ্গুলের মতো প্রবর্ধনযুক্ত হয়ে ঝালর বা ফিমব্রি (fimbriae)-তে পরিণত হয়। পরের ফানেলাকার অংশটি ইনফান্ডিবুলাম (infundibulum)। এর স্ফীত অংশ অ্যাম্পুলা (ampulla) এবং যে মধ্য অংশটি জরায়ু-প্রাচীরের কাছে থাকে তা ইসথমাস (isthmus)।
কাজ: ডিম্বনালি ডিম্বাশয় থেকে মুক্ত পরিণত ডিম্বাণু গ্রহণ করে জরায়ুতে পৌছে দেয় এবং রস ক্ষরণ করে শুক্রাণুকে। উর্ধ্বপ্রান্তে উঠে ডিম্বাণুকে নিষিক্তকরণে সাহায্য করে।
৩. জরায়ু (Uterus): এটি দেখতে উল্টানো নাশপাতির মতো, ফাঁপা, মাংসল অঙ্গ এবং মূত্রাশয়ের পিছনে ও মলাশয়ের সামনে শ্রোণিগহ্বরে অবস্থিত। জরায়ু-প্রাচীর বহিঃস্থ পেরিমেট্রিয়াম (perimetrium), মধ্যস্থ মায়োমেট্রিয়াম (myometrium) এবং অন্তঃস্থ এন্ডোমেট্রিয়াম (endometrium)-এ গঠিত। জরায়ুর উপর দিকে গম্বুজ আকৃতির অংশকে ফান্ডাস (fundus), মাঝের অংশকে জরায়ুদেহ (body of uterus) এবং নিচের অংশকে সারভিক্স (cervix) বা জরায়ুকণ্ঠ বলে। বয়ঃসন্ধিক্ষণে জরায়ু পূর্ণতা লাভ করে, কিন্তু গর্ভাবস্থায় এটি প্রায় ২০ গুণ বৃদ্ধি পায়।
কাজ: জরায়ু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভ্রুণকে আগলে রক্ষা করে এবং পরিস্ফুটন সম্ভবপর করে তোলে। এখান থেকে অমরা সৃষ্টি হয়ে ভ্রুণের পুষ্টি, রেচন ও শ্বসন সম্পন্ন করে।
৪. যোনি (Vagina): এটি শুক্রাণু গ্রহণের সাথে সম্পর্কযুক্ত স্ত্রীদেহের একটি মাংসল, ৮-১০ সেন্টিমিটার লম্বা নলাকার খাদ যা মূত্রাশয়ের নিচ দিয়ে দেহের অভ্যন্তরে অবস্থিত জরায়ু থেকে বাইরে উন্মুক্ত।
কাজ: যোনি মাংসল প্রাচীরের সাহায্যে যে কোনো আকারের শিশ্নকে গ্রহণ করে।
৫. বহিঃযৌনাঙ্গ (External genitalia): যোনির মুখে স্নায়ুসমৃদ্ধ কতকগুলো অঙ্গ দেখা যায়, এগুলোকে একত্রে ভালভা (vulva) বলে। দুজোড়া মাংসল ভাজ উভয় পার্শ্ব থেকে যোনিপথকে কপাটের মতো ঢেকে রাখে। এদের মধ্যে বাইরের অধিকতর মোটা এবং বৃহদাকার ভাঁজকে লেবিয়া মেজোরা (labia majora) এবং ভিতরের দিকে তুলনামূলকভাবে পাতলা এবং ক্ষুদ্র ভাজকে লেবিয়া মাইনোরা (labi minora) বলে। লেবিয়া মেজোরার একেবারে উপরে জোড়ের কাছে একটি উচু ছোট মাংসপিন্ড দেখা যায়, একে ক্লাইটোরিস (clitoris) বলে। বার্থোলিন গ্রন্থি (Bartholin’s gland) বা ভগাংকুর নামে দুটি বড় গ্রন্থিও লেবিয়া মাইনোরায় উনাক্ত হয়েছে।
কাজ: লেবিয়া মেজোরা ও লেবিয়া মাইনোরা যোনিপথকে ঢেকে রাখে। বার্থোলিন গ্রন্থিক্ষরণ যৌনমিলনের সময় যোনিপথকে পিচ্ছিল করে তোলে। ক্লাইটোরিস সঙ্গমের সময় উত্তেজনা প্রদান করে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
স্ত্রী প্রজননতন্ত্রের হরমোনাল ক্রিয়াঃ
১. ডিম্বাশয়ের কর্পাস লুটিয়ার কোষগুলো ইস্ট্রোজেন (estrogen) ও প্রোজেস্টেরন (progesterone) নামে দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্ত্রী যৌন হরমোন ক্ষরণ করে। ইস্ট্রোজেন হরমোন স্ত্রী জননাঙ্গের, যেমন-স্তনের এবং এন্ডোমেট্রিয়ামের বৃদ্ধি ঘটায়। এটি স্ত্রী চরিত্রের পরিস্ফুটন ঘটায় এবং পরিণত বয়সে মাসিক বা রজঃচক্র নিয়ন্ত্রণ করে।
২. প্রোজেস্টেরন জ্বণের পরিস্ফুটনের জন্য জরায়ুর ভিতর উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে।
৩. পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন (FSH) ওভারিয়ান ফলিকলের বৃদ্ধি, ডিম্বপাত (ওভিউলেশন) ও ইস্ট্রোজেন সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।
৪. পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত লুটিনাইজিং হরমোন (LH) এর প্রভাবে গ্রাফিয়ান ফলিকল করপাস লুটিয়ামে পরিণত হয়।
৫. অমরা থেকে ক্ষরিত hCG (Human Chorionic Gonadotropin) হরমোনগুলো স্ত্রীজননাঙ্গের বৃদ্ধি, দুগ্ধ ক্ষরণ ও ফিটাসের বর্ধনের জন্য গুকোজ সরবরাহ নিশ্চিত করে।
৬. hCG কর্পাস লুটিয়ামকে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরণ সংশ্লেষ ও বিতরণে উদ্দীপ্ত করে।
৭. ডিম্বাশয় ও অমরা থেকে ক্ষরিত রিলাক্সিন (relaxin) হরমোন মহিলাদের প্রসবের সময় শ্রোণিদেশীয় লিগামেন্ট ও পেশির প্রসারণ ঘটিয়ে প্রশ্রব সহজতর করে।
বয়ঃসন্ধিকাল বা বয়ঃপ্রাপ্তি (Puberty or Adolescence)
জীবনের যে পর্যায়ে নারী ও পুরুষের গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্যের (secondary sexual characteristics) উদ্ভবসহ প্রজননতন্ত্রের অঙ্গগুলো সক্রিয়তা লাভে সমর্থ হয় তাকে বয়ঃসন্ধিকাল বলে। অর্থাৎ কৈশোর এবং সাবালকত্ব প্রাপ্তির অন্তবর্তীকালীন সময় হচ্ছে বয়ঃসন্ধিকাল (puberty is the time between childhood and adulthood)। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে ছেলেদের বয়ঃসন্ধিকালের বয়স ১৩-১৫ বছর এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে ১১-১৩ বছর বলে বিবেচনা করা হয়।
বয়ঃসন্ধি কালে দৈহিক,শারীরিক ও মানসিক যেসব পরিবর্তন দেখা দেয় নিচে তা আলোচনা করা হলোঃ
বৈশিষ্ট্য | পুরুষ | নারী |
---|---|---|
লোম | মুখ, বগল, শ্রোণিদেশে লোম | বগল ও শ্রোণিদেশে লোম |
পেশি | বলিষ্ঠ ও সুগঠিত হয় | তেমন নয় |
মেদ | মুখ ও পেটে সঞ্চিত হয় | কোমর ও নিতম্বে সঞ্চিত হয় |
স্তন | প্রায় স্বাভাবিক থাকে | প্রচুর মেদ সঞ্চিত হয়ে সুডৌল ও উন্নত করা |
কণ্ঠস্বর | গাঢ়, ভারী ও গম্ভীর হয়ে উঠে | মেয়েলী স্বর প্রকাশ পায় |
হৃৎপিন্ডের গতি ও রক্তচাপ | বৃদ্ধি পায় | বৃদ্ধি পায় |
শ্বাসপ্রশ্বাস | গভীর হয় | গভীর হয় |
মৌল বিপাকীয় হার | বৃদ্ধি পায় | হ্রাস পায় |
লোহিত রক্তকণিকা | অনেক বৃদ্ধি পায় | কিছু পরিমাণ হ্রাস পায় |
জননাঙ্গের হরমোন | উৎপন্ন ও ক্ষরিত হতে থাকে | উৎপন্ন ও ক্ষরিত হতে থাকে |
জননকোষ | শুক্রাণুসহ বীর্য উৎপন্ন ও স্খলিত হয় | রজঃচক্র আরম্ভ হয় |
আনুষঙ্গিক জনন অঙ্গ | সুগঠিত ও কার্যক্ষম হয়ে উঠে | সুগঠিত ও কার্যক্ষম হয়ে উঠে |
বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ | মেয়েদের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পায় | ছেলেদের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পায় |
ভাব | বিচিত্র খেয়াল ও ভাব মনে জেগে উঠে | নারীসুলভ মানসিকতার প্রকাশ ঘটে |
রজঃচক্র (Menstrual cycle: ল্যাটিন mensis = month) স্ত্রীলোকের সমগ্র যৌন জীবনকালে প্রতি ২৮ দিন (২৪-৩২ দিন) অন্তর ৩-৫ দিন ধরে জরায়ুর অন্তঃস্থ স্তর বা এন্ডোমেট্রিয়ামের অবক্ষয়ের ফলে রজঃস্রাব এবং পরে দেহের অন্যান্য জননাঙ্গসমূহের যেমন-ডিম্বাশয়, জরায়ু ইত্যাদির যে পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন ঘটে তাকে রজঃচক্র বলে। প্রথম রজচক্রকে মেনার্কি (menarche) এবং যৌন জীবনকালের শেষে রজঃচক্রের নিবৃত্তি বা বন্ধ হওয়াকে মেনোপজ (menopause) বলে।
রজঃচক্রের প্রক্রিয়া (Process of menstrual cycle):
প্রায় ৮০% নারী রজঃচক্র শুরুর ১/২ সপ্তাহ আগে থেকেই কিছু উপসর্গ বুঝতে পারে। সাধারণ উপসর্গের মধ্যে রয়েছে ব্রণ ওঠা, স্তন স্পর্শকাতর ও স্ফীত হওয়া, পরিশ্রান্ত, খিটখিটে ও অস্থির মেজাজ ইত্যাদি। এসব উপসর্গ দৈনন্দিন কাজকর্মের ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, তাই এগুলোকে প্রাক রজঃচক্রীয় উপসর্গ (premenstrual syndrome) বলে। রজঃচক্রের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া দুটি চক্রের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, একটি ডিম্বাশয় চক্র, অন্যটি জরায়ু চক্র।
ডিম্বাশয় চক্র (Ovarian cycle)
১. ফলিকুলার পর্যায় (Follicular phase): ডিম্বাশয় চক্রের যে অংশে ডিম্বাশয় ফলিকলের বৃদ্ধি ঘটে এবং উওসাইট পরিণত হয় তাকে ফলিকুলার পর্যায় বা ফলিকুলোজেনেসিস (folliculosenesis) বলে। প্রত্যেক ডিম্বাশয়ে অনেক ফলিকল (follicle) থাকে এবং প্রত্যেক ফলিকলে থাকে একটি করে প্রাইমারি উওসাইট। প্রাইমারি উওসাইট পুষ্টি সরবরাহকারী গ্র্যানুলোসা কোষ (granulosa cells)-এর একটি স্তরে পরিবৃত থাকে। প্রাইমারি উওসাইট ও গ্র্যানুলোসা একত্রে অপরিণত ফলিকল গঠন করে। ডিম্বাশয় চক্রের শুরুতে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস থেকে GnRH ক্ষরণ বেড়ে যায় এবং সম্মুখ পিটুইটারি গ্রন্থি FSH ও LH ক্ষরণ বাড়িয়ে দেয়। এ দুই হরমোন একদিকে ফলিকলের বৃদ্ধি ও আকার পরিবর্তনকে যেমনি উদ্দীপ্ত করে, অন্যদিকে ফলিকলকে ইস্ট্রোজেন ক্ষরণে উদ্বুদ্ধ করে। গ্র্যানুলোসা কোষগুলো থেকে এক ধরনের চিনিজাতীয় পদার্থ (গ্লাইকোপ্রোটিন) ক্ষরিত হয় এবং উওসাইটের চারপাশে অকোষীয় স্তর হিসেবে অবস্থান নেয়। ফলিকলের ভিতরে তখন তরলে পূর্ণ একটি গহ্বর বা অ্যান্ট্রাম (antrum) সৃষ্টি হয়। গ্র্যানুলোসা কোষ থেকে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্ট্রেরন ক্ষরণ শুরু হয়। প্রাইমারি উওসাইট মিয়োসিস-১ দশা সম্পন্ন করে একটি সেকেন্ডারি উওসাইট ও একটি অকার্যকর পোলার বডি সৃষ্টি করে। পরিণত ফলিকল (গ্রাফিয়ান ফলিকল নামে পরিচিত) একটি সেকেন্ডারি উওসাইট, একটি পোলার বডি ও অসংখ্য গ্র্যানুলোসা কোষে গঠিত। এটি ডিম্বাশয়ের কোনো এক পাশে তরলে পূর্ণ গহ্বরযুক্ত স্ফীতি হিসেবে এবং ডিম্বাশয়ের যোজক বা কানেকটিভ (connective) টিস্যুকোষে বেষ্টিত হয়ে অবস্থান করে।
২. ডিম্বপাত পর্যায় (Ovulatory phase): রজঃচক্রের সময় নির্দিষ্ট হরমোনের উদ্দীপনায় ডিম্বাশয়ে পরিণত ফলিকল থেকে সেকেন্ডারি উওসাইটের নির্গমনকে ডিম্বপাত বলে। কম মাত্রার ইস্ট্রোজেন পিটুইটারি হরমোনের ক্ষরণকে বাধা দেয়, ফলে FSH ও LH-এর মাত্রা অপেক্ষাকৃত কম থাকে। ফলিকল থেকে ইস্ট্রোজেন ক্ষরণ বেড়ে গেলে FSH ও LH মাত্র উল্লেখযোগ্য পরিমানে বেড়ে যায়। চক্রের ১২তম দিনে হঠাৎ LH-এর পরিমাণ প্রচণ্ড বেড়ে যাওয়ায় একদিনের মধ্যে ডিম্বপাত (ovulation) ঘটে।
৩. লুটিয়াল পর্যায় (Luteal phase): ডিম্বপাতের পর শুরু হয় লুটিয়াল পর্যায়। লুটিনাইজিং হরমোন অবশিষ্ট ফলিকুলার টিস্যুকে উদ্দীপ্ত করে কর্পাস লুটিয়াম নামক একটি হলদে গ্রন্থিময় পিন্ডে পরিণত করে। এটি LH-এ উদ্দীপ্ত হয়ে প্রচুর প্রোজেস্টেরন ও সামান্য ইস্ট্রোজেন ক্ষরণ করে। হরমোন দুটি নিষিক্ত ডিম্বাণুর সম্ভাব্য আগমন, সংস্থাপন ও পরিস্ফুটনের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে এন্ডোমেট্রিয়ামকে প্রস্তুত করে রাখে। উচ্চ মাত্রার ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন ক্ষরণের ফলে হাইপোথ্যালামাস FSH-এর নিঃসরণ এতটাই কমিয়ে দেয় যেন সাময়িকভাবে আর কোনো ফলিকলের পরিস্ফুটন না ঘটে।
জরায়ু চক্র (Uterine cycle)
১. রজঃস্রাবীয় বা ব্লিডিং পর্যায় (Menstrual or Bleeling phase):
১ম-৫ম দিন: জরায়ু চক্রের যে পর্যায়ে রজঃস্রাব (menses) নিষ্কাশিত হয় তাকে রজঃস্রাবীয় পর্যায় বলে। ডিম্বপাতের পর ডিম্বাণ ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে নিষিক্ত না হলে কর্পাস লুটিয়াম থেকে নিঃসত ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের প্রভাবে সম্মুখ পিটুইটারি গ্রন্থি FSH ও LH ক্ষরণ বন্ধ করে দেয়। LH-এর অভাবে কর্পাস লুটিয়ামের কর্মতৎপরতা বন্ধ হয়ে বিধ্বস্ত হয়। চক্রের এ পর্যায় ৪টি হরমোনের (ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন ফলিকল স্টিমুলেটিং হরমোন ও লুটিনাইজিং হরমোন) ক্ষরণ মাত্রাই নিম্নতম পর্যায়ে থাকে।ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের ক্ষরণমাত্রা কমে যাওয়ায় এন্ডোমেট্রিয়ামের আর বৃদ্ধি ঘটে না, বরং তা ভাঙতে শুরু করে। রক্তের অভাবে তখন এন্ডোমেট্রিয়ামের ধমনিকুন্ডলী প্রসারিত হয়, ফলে ধমনিকা ও কৈশিকজালিকা ছিন্নভিন্ন হলে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। পরে অবশ্য কিছু রক্তবাহিকার সংকোচনে স্থানীয় রক্তপাত বন্ধ হয়, কিন্তু অন্যান্য রক্তবাহিকার অক্ষমতার জন্য রক্তক্ষরণ ৪-৫ দিন স্থায়ী হয়। এ সময় রক্তের সাথে এন্ডোমেট্রিয়াম, রক্তবাহিকার ভগ্নাংশ ও অনিষিক্ত ডিম্বাণু যোনিপথে নিষ্কাশিত হয়। এসব পদার্থকে রজঃস্রাব বলে। প্রত্যেক জরায়ু চক্রে রজঃস্রাবের পরিমাণ ৩০-৪০ মিলিলিটার।
২. বর্ধনশীল পর্যায় (Proliferative phase):
৬-১৪তম দিন: রজঃচক্রের যে পর্যায়ে পরিস্ফুটনের পরবর্তী ফলিকল (ভবিষ্যতে ফলিকল) থেকে ডিম্বপাতের (ovulation) পূর্ব পর্যন্ত ক্ষরিত প্রচুর পরিমাণ ইস্ট্রোজেনের প্রভাবে এন্ডোমেট্রিয়াল স্তর দ্রুত পুনর্নির্মিত হয়ে নিষিক্ত ডিম্বাণু ধারণ ও নিরাপদ পরিস্ফুটন নিশ্চিত করে সে পর্যায়কে বর্ধনশীল পর্যায় বলে। এ পর্যায়ে জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়াল স্তর প্রায় ৩-৪ মি.মি. পুরু হয়, রক্তবাহিকা ও গ্রন্থিসমৃদ্ধ হয়। ডিম্বাশয়ে যখন বর্ধনশীল ফলিকলের ফলিকল কোষ থেকে প্রচুর পরিমাণ ইস্ট্রোজেন হরমোন ক্ষরিত হয় তখন FSH ও LH মাত্রাও বেড়ে যায়। ১৪তম দিনে অর্থাৎ চক্রের ঠিক মধ্যবর্তী সময়ে ডিম্বপাত ঘটে।
৩. ক্ষরণশীল পর্যায় (Secretory phase):
১৫-২৮তম দিন: রজঃচক্রের যে পর্যায়ে ব্লাস্টোসিস্ট ধারণের জন্য জরায়ুর কর্পাস লুটিয়াম থেকে ক্ষরিত প্রোজেস্টেরন ও সামান্য পরিমাণ ইস্ট্রোজেনের প্রভাবে এন্ডোমেট্রিয়াম পুনর্গঠিত পর্যায়ে অপেক্ষমান থাকে, তাকে ক্ষরণশীল পর্যায় বলে। এ পর্যায়ে জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়ামের কোষগুলো বৃদ্ধি পায়, প্রাচীরের স্থলতা প্রায় ৩ গুণ বেড়ে যায়। জরায়ুতে অবস্থিত গ্রন্থিগুলো পরিণত হয়ে ভ্রুণের পুষ্টির উৎস হিসেবে গ্লাইকোজেন উৎপন্ন করে এবং এমন সব উপাদান ক্ষরণ করে যাতে এন্ডোমেট্রিয়ামের গঠন ধরে রাখে ও বিধ্বস্ত হওয়া থেকে রক্ষা পায়। বর্ধনশীল পর্বে সার্ভিক্সে ক্ষরিত পাতলা মিউকাস স্তর এ পর্যায়ে ঘন ও চটচটে হয়ে সার্ভিকাল প্লাগ (cervical plug) গঠন করে, ফলে ব্যাকটেরিয়া বা আর কোনো শুক্রাণু জরায়ুর ভিতর প্রবেশ করতে পারে না।
রজঃচক্রের তাৎপর্য (Significance of Menstrual Cycle):
রজঃচক্র মেয়েদের যৌন জীবনকালের সূচনা করে;
*এটি স্ত্রীলোকের প্রজনন সক্ষমতা নির্দেশ করে;
*রজঃচক্র স্ত্রীলোকের সন্তান উৎপাদন সক্ষমতা নির্দেশ করে এবং প্রতিমাসে একবার গর্ভধারণের সুযোগ সৃষ্টি করে;
*রজঃচক্র ডিম্বাণু উৎপাদন, ডিম্বথলির পরিপক্কতা; ডিম্বপাত, শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন, ভ্রুণ সৃষ্টি এবং জরায়ুকে ভ্রণ ধারণ ও পোষণের উপযোগী করার সুযোগ সৃষ্টি করে;
*নিয়মিত রজঃচক্র মেয়েদের যৌন সুস্থতার বহিঃপ্রকাশ;
*অনিয়মিত রজঃচক্র মেয়েদের যৌন অসুস্থতার প্রকাশ করে;
গ্যামেট সৃষ্টি (Formation of Gametes) বা গ্যামেটোজেনেসিস (Gametogenesis):
যে প্রক্রিয়ায় জনন অঙ্গের (শুক্রাশয় ও ডিম্বাশয়) প্রাইমর্ডিয়াল জননকোষ (জনন মাতৃকোষ) থেকে গ্যামেট (শুক্রাণু ও ডিম্বাণু) উৎপন্ন হয়ে নিষেকে সক্ষম হয়ে উঠে তাকে গ্যামেটোজেনেসিস (গ্রিক gamos = জননকোষ এবং genesis = উৎপত্তি হওয়া) বলে।
ক. শুক্রাণু সৃষ্টি বা স্পার্মাটোজেনেসিস (spermatogenesis):
পূর্ণাঙ্গ শুক্রাণু সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে স্পার্মাটোজেনেসিস (spermatogenesis: গ্রিক sperma = শুক্রাণু + genesis = জনন বা সৃষ্টি) বলে।
নিচে মানুষের স্পার্মাটোজেনেসিস প্রক্রিয়া বর্ণনা করা হলো। ক্রমবর্ধনের উপর ভিত্তি করে সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে নিচে বর্ণিত চারটি ধাপে ভাগ করা যায়।
১. সংখ্যাবৃদ্ধি পর্যায় (Multiplication phase): শুক্রাশয়ের সেমিনিফেরাস নালিকার জার্মিনাল এপিথেলিয়াল কোষ (seminal epithelial cell, 2n) বার বার মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বিভাজিত হয়। উৎপন্ন কোষগুলোকে স্পার্মাটোগোনিয়া (spermatogonia, একবচনে-spermatogonium) বলে। স্পার্মাটোগোনিয়ামকে (2n) শুক্রাণু মাতৃকোষ-ও বলা হয়।
২. পরিবর্ধন পর্যায় (Growth phase): প্রত্যেক স্পার্মাটোগোনিয়াম সেমিনিফেরাস নালিকার সারটলি কোষ থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে আয়তনে বড় হয়। এ কোষগুলোকে প্রাইমারি স্পার্মাটোসাইট (primary spermatocyte) বলে। এসব কোষের নিউক্লিয়াস আয়তনে বেশ বড় এবং ক্রোমোজোমগুলোতে মিয়োসিসের ইন্টারফেজ দশার লক্ষণ প্রকাশ পায়।
৩. পূর্ণতাপ্রাপ্তি পর্যায় (Maturation phase): এ পর্যায়ের শুরুতে প্রাইমারি স্পার্মাটোসাইটগুলোতে প্রথম মিয়োসিস বিভাজন ঘটে, ফলে সৃষ্ট কোষগুলো হ্যাপ্লয়েড (n) প্রকৃতির হয়। এদের সেকেন্ডারি স্পার্মাটোসাইট (secondar spermatocyte) বলে। এগুলো প্রতিটি দ্বিতীয় মিয়োসিস বিভাজনের মাধ্যমে দুটি করে স্পার্মাটিড (spermatid) সৃষ্টি করে। এভাবে পূর্ণতাপ্রাপ্তি পর্যায়ে একটি ডিপ্লয়েড প্রাইমারি স্পার্মাটোসাইট (2n) থেকে চারটি হ্যাপ্লয়েড স্পার্মাটিড (n) গঠিত হয়।
৪. স্পার্মিওজেনেসিস (Spermiogenesis): যে জটিল প্রক্রিয়ায় চলাচলে অক্ষম, গোলাকার স্পার্মাটিড ধারাবাহিক ও সম্পূর্ণ আঙ্গিক পরিবর্তনের মাধ্যমে, আর কোন বিভাজন ছাড়াই সচল শুক্রাণুতে পরিণত হয় তাকে স্পার্মিওজেনেসিস বলে। প্রথমে স্পার্মাটিডের নিউক্লিয়াসটি পানি, RNA ও নিউক্লিয়াস পরিত্যাগ করে সঙ্কুচিত হয় এবং শুক্রাণুর মাথা গঠন করে। স্পার্মাটিডে গলজি বডি থেকে অ্যাক্রোসোম (acrosome) সৃষ্টি হয়ে শুক্রাণুর মাথায় টুপির মতো অবস্থান করে। স্পার্মাটিডের সেন্ট্রিওল শুক্রাণুর অক্ষীয় সূত্রক ও লেজ গঠন করে। এভাবে স্পার্মাটিড রূপান্তরিত সচল, লম্বাকৃতির ও প্রায় সাইটোপ্লাজমবিহীন শুক্রাণুতে পরিণত হয়। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ৬০-৭০ দিন সময় লাগে।
মানুষের শুক্রাণুর গঠন (Structure of Human sperm)
শুক্রাণুদেহ চারটি প্রধান অংশে বিভক্ত:
• মাথা (Head): মাথা হচ্ছে শুক্রাণুর সামনের অংশ যা দেখতে স্ফীতকায়, কোণাকার বা লেন্সের মত। মাথার সাইটোপ্লাজমের অধিকাংশ জুড়ে থাকে একটি ডিম্বাকার নিউক্লিয়াস। এতে ক্রোমোজোম (n সংখ্যক) থাকায় পিতার বংশগতি সন্তানে সঞ্চারিত হয়। এর সামনের অর্ধেক অংশের উপরে নিউক্লিয়াসকে ঢেকে থাকে অ্যাক্রোসোম। অ্যাক্রোসোমে উপস্থিত টিস্যু গলনকারী এনজাইমগুলো ডিম্বাণুর ঝিল্লি ভেদ করে ভিতরে প্রবেশে সাহায্য করে।
• গ্রীবা (Neck): গ্রীবা হচ্ছে শুক্রাণুর মাথার ঠিক পিছনে মাথা ও মধ্যখন্ডের মাঝখানে অবস্থিত একটি সরু, স্বচ্ছ সংযোগস্থল। এখানে পরস্পরের সাথে সমকোণে দুটি সেন্ট্রিওল থাকে।
• মধ্য খন্ড (Middle piece): সাইটোপ্লাজম, মাইটোকন্ড্রিয়া ও অক্ষীয় সূত্রে গঠিত অংশটি হচ্ছে শুক্রাণুর মধ্য খন্ড।
• লেজ বা ফ্ল্যাজেলাম (Tail or Flagellum): শুক্রাণুর মধ্যখণ্ডের সাইটোপ্লাজম ও মাইটোকন্ড্রিয়ার সমাপ্তির অংশ থেকে শুরু করে পিছনের। সবটুকুই লেজ বা ফ্ল্যাজেলাম। এটি শুক্রাণুর দীর্ঘতম অংশ। ফ্ল্যাজেলাম শুক্রাণুকে গতিশীল করে নিষেকের উদ্দেশে ডিম্বাণুর কাছে পৌছাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
খ. ডিম্বাণু সৃষ্টি বা উওজেনেসিস (Oogenesis):
ডিম্বাশয়ের অভ্যন্তরে ডিম্বাণু সৃষ্টির পদ্ধতিকে উওজেনেসিস (oogonesis; গ্রিক oon = ডিম্বাণু + genesis = সৃষ্টি বা জনন) বলে।
১.সংখ্যাবৃদ্ধি পর্যায় (Multiplication phase): ডিম্বাশয়ের জার্মিনাল এপিথেলিয়াল কোষ (2n) বার বার মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বিভক্ত হয়ে উওগোনিয়া (oogonia, একবচনে- oogonium) সৃষ্টি করে। উওগোনিয়ামে ডিপ্লয়েড (2n) সংখ্যক ক্রোমোজোম থাকে।
২. পরিবর্ধন পর্যায় (Growth phase): সাইটোপ্লাজমে লিপিড, প্রোটিন ইত্যাদি কুসুম আকারে জমা হওয়ায় উওগোনিয়ামটি আয়তনে বড় হয়। একই সময়ে নিউক্লিয়াসের আয়তন ও বিপাকীয় কাজসহ প্রোটিন সংশ্লেষণ অনেক বৃদ্ধি পায়। পরিবর্ধিত এ উওগোনিয়ামকে প্রাইমারি উওসাইট (primary oocyte) বলে। প্রতিটি প্রাইমারি উওসাইট (2n) একস্তর গ্রানুলোসা বা ফলিকল কোষ (granulosa or follicle cells)-এ আবৃত হয়ে প্রাইমারি ফলিকল (primary follicle)-এ পরিণত হয়।
৩. পূর্ণতাপ্রাপ্তি পর্যায় (Maturation phase): বয়ঃসন্ধিকাল থেকে প্রতি মাসে কিছু প্রাইমারি ফলিকল বৃদ্ধি লাভ করে। এর মধ্যে সাধারণত একটি পরিণত হয়, অন্যগুলো বিলুপ্ত হয়। পরিণত প্রাইমারি ফলিকলকে গ্রাফিয়ান ফলিকল (graafian follicle) বলে। বৃদ্ধিরত প্রাইমারি ফলিকলের অভ্যন্তরস্থ প্রাইমারি উওসাইট প্রথম মিয়োটিক বিভাজন-এর মাধ্যমে দুটি অসম কোষ উৎপন্ন করে। বড় কোষটিকে সেকেন্ডারি উওসাইট (secondary oocyte, n) এবং ছোট কোষটিকে ১ম পোলার বডি (1st polar body) বলে। এরপর ১ম পোলার বডি মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বিভাজিত হয়ে দুটি পোলার বডি সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, সেকেন্ডারি উওসাইটটি নিষেকের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। সেকেন্ডারি উওসাইট অবস্থায় ডিম্বপাত বা ওভ্যুলেশন (ovulation) ঘটে। নিষেকের সময় কোন শুক্রাণু ডিম্বাণুর জোনা পেলুসিডা ভেদ করতে পারলে তখন সেকেন্ডারি উওসাইটে দ্বিতীয় মিয়োটিক বিভাজন সম্পন্ন হয়। এ বিভাজনে সেকেন্ডারি উওসাইটটি অসমভাবে বিভক্ত হয়ে একটি বড় হ্যাপ্লয়েড উওটিড (ootid) ও একটি ছোট পোলার বডি (n) সৃষ্টি করে। এভাবে পূর্ণতাপ্রাপ্তি পর্যায়ে একটি প্রাইমারি উওসাইট থেকে একটি বড় উওটিড ও তিনটি ছোট পোলার বডি সৃষ্টি হয়।
৪. রূপান্তর পর্যায়: এ পর্যায়ে উওটিড রূপান্তরিত হয়ে কার্যকর ওভাম (ovum) বা ডিম্বাণু-তে পরিণত হয়। তবে শুক্রাণুর মতো এক্ষেত্রে আকৃতি ও আকারে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে না। কেবল নিষেকের প্রস্তুতি লাভের জন্য এর ভিতরের পদার্থের সামান্য পরিবর্তন ঘটে। সকল পোলার বডি বিনষ্ট হয়ে পরিত্যক্ত হয়।
মানুষের ডিম্বাণুর গঠন (Structure of Human ovum or egg)
প্রতিটি পরিপক্ক ডিম্বাণুকে তিনটি অংশে ভাগ করা যায়, যথা: ডিম্বাণু ঝিল্লি, নিউক্লিয়াস ও সাইটোপ্লাজম। নিচে এদের বর্ণনা দেয়া হলো।
১. ডিম্বাণু ঝিল্লি (Egg membrane): ডিম্বাশয় থেকে যে ডিম্বাণুর নির্গমন ঘটে তা সম্পূর্ণ পরিণত ডিম্বাণু নয়। প্রকৃতপক্ষে এটি সেকেন্ডারি উওসাইট যা আরেক দফা বিভাজনের মাধ্যমে (দ্বিতীয় মিয়োটিক বিভাজন) দ্বিতীয় পোলার বডি সৃষ্টি ও ত্যাগ করবে। এ অবস্থায় সম্পূর্ণ ডিম্বাণু গ্লাইকোপ্রোটিন সমৃদ্ধ জোনা পেলুসিডা (zona pellucida) নামক একটি প্রাইমারি আবরণে দৃঢ়ভাবে আবৃত থাকে। পরবর্তী সময়ে চারদিকে জোনা পেলুসিডা ও সাইটোপ্লাজমের মধ্যবর্তী অংশ তরলে পূর্ণ জায়গায় পরিবৃত হয়। এ জায়গাটিকে পেরিভাইটেলাইন ফাঁক (perivitelline space) বলে। প্রথম পোলার বডিকে এ ফাঁকা স্থানে দেখা যায়। ডিম্বাশয় থেকে যখন ডিম্বাণু মুক্ত হয় তখন জোনা পেলুসিড়া চারদিক ঘিরে ফলিকল কোষের স্তর বয়ে করে আনে। এ স্তরটি করোনা রেডিয়েটা (coron radiata) নামে পরিচিত। ডিম্বনালি বেয়ে নামার সময় এ স্তরের কোষগুলো খসে পড়ে।
২. সাইটোপ্লাজম বা উওপ্লাজম (ooplasm): ডিম্বাণুর সাইটোপ্লাজম উওপ্লাজম নামে পরিচিত। এতে প্রচুর গলজি বডি, মাইটোকন্ড্রিয়া, এন্ডোপ্লাজমিক রেটিকুলাম ও কর্টিক্যাল গ্র্যানিউল (cortical granule) থাকে। মানুষের ডিম্বাণুতে কুসুমের পরিমাণ অতিসামান্য এবং সাইটোপ্লজমে সমানভাবে ছড়ানো থাকে। তাই মানুষের ডিম্বাণুকে মাইক্রোলেসিথাল ডিম্বাণু (microlecithal egg) বলে।
৩. নিউক্লিয়াস (Nucleus): ডিম্বাণুর নিউক্লিয়াস বেশ বড়, কেন্দ্র থেকে একটু সরে অবস্থান করলেও নিষেকের সময় কেন্দ্রে চলে আসে। নিউক্লিয়াসে প্রচুর RNA ও ২৩টি ক্রোমোজোম থাকে।
গ্যামেটোজেনেসিস এর তাৎপর্য (Importance of Gametogenesis):
১. যৌন জননে অংশগ্রহণকারী জীব গ্যামেটোজেনেসিসের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ক্রোমোজোম সংখ্যা অপরিবর্তিত রাখে। গ্যামেটোজেনেসিস ছাড়া জেনেটিক ভারসাম্যযুক্ত অপত্য জীব সৃষ্টি সম্ভব হতোনা।
২. গ্যামেটোজেনেসিসের সময় মিয়োসিস বিভাজন সংঘটিত হয়। এ সময় ক্রসিং ওভারের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন জেনেটিক গঠন বিশিষ্ট জনন কোষ উৎপন্ন হয়, যা জীবজগতে প্রকরণের উদ্ভব ঘটায়।
৩. উওজেনেসিস প্রক্রিয়ায় প্রতিমাসে সাধারণত একটি নিশ্চল ডিম্বাণু সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে স্পার্মাটোজেনেসিস প্রক্রিয়ায় প্রতিদিন কোটি কোটি সচল শুক্রাণু উৎপন্ন হয়। এটি নিষেক ঘটার সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করে এবং প্রজাতির ধারা অব্যাহত রাখে।
৪. ডিম্বাণুতে সঞ্চিত কুসুম নিষেক পরবর্তী ভ্রূণ বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান দেয়।
নিষেক (Fertilization):
শুক্রাণু নিউক্লিয়াস ও ডিম্বাণু নিউক্লিয়াসের একীভবনের মাধ্যমে ডিপ্লয়েড (2n) জাইগোট সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে নিষেক বলে নিষেক একটি জটিল প্রক্রিয়া। বিভিন্ন প্রাণিগোষ্ঠী এমনকি একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যেও এ প্রক্রিয়ার বৈচিত্র্য উল্লেখযোগ্য মানবদেহে যে নিষেক ঘটে তা প্রকৃতপক্ষে সেকেন্ডারি উওসাইট ও পরিণত শুক্রাণুর নিউক্লিয়াসের একীভবন। এ প্রক্রিয়ার ধাপগুলো নিম্নরূপঃ
• স্খলিত শুক্রাণুগুলোর অ্যাক্রোসোম থেকে হায়ালুরোনিডেজ নামক এনজাইম ক্ষরিত হয়। ডিম্বাণুর চারদিকে অবস্থিত ফলিকল কোষগুলো যে সব পদার্থের সাহায্যে পরস্পর যুক্ত থাকে সে সব পদার্থকে এ এনজাইম পরিপাকের মাধ্যমে শুক্রাণুর গমন পথের সৃষ্টি করে।
• গমন পথ ধরে শুক্রাণু লেজের সাহায্যে চালিত হয়ে ডিম্বাণুর জোনা পেলুসিডার বহির্দেশে এসে পৌঁছে (সেকেন্ডারি উওসাইটের চতুর্দিক ঘিরে অবস্থিত পুরু স্তরকে জোনা পেলুসিডা বলে)। এ স্তরে অবস্থিত বিশেষ সংগ্রাহক প্রোটিনে শুক্রাণুর মস্তকঝিল্লির সংগ্রাহকগুলো বন্ধনের সৃষ্টি করে।
• বন্ধনের ফলে উদ্দীপ্ত হয়ে শুক্রাণুমস্তক আরেক ধরনের এনজাইম ক্ষরণ করে। এ এনজাইম জোনা পেলুসিডার অংশকে হজম করে একটি পথের সৃষ্টি করে। এ পথ ধরে শুক্রাণু ডিম্বাণু-ঝিল্লির বহির্তলে এসে পৌঁছায়। এর মস্তকটি ডিম্বাণুর ভিলাই-সমৃদ্ধ প্লাজমামেমব্রেনের সাথে একীভূত হয় এবং ডিম্বাণুর সাইটোপ্লাজমে প্রবেশ করে
• শুক্রাণু-মস্তক ডিম্বাণুর অভ্যন্তরে প্রবেশের সাথে সাথে ডিম্বাণুর বহির্দেশে অবস্থিত কর্টিকাল দানা (cortical বিভিন্ন granules) নামে পরিচিত লাইসোজোমগুলো এনজাইম ক্ষরণ করে । এনজাইমের প্রভাবে জোনা পেলুসিডা পুরু ও শক্ত হয়ে নিষেক ঝিল্লি (fertilization membrane) সৃষ্টি করে। ফলে আর কোনো শুক্রাণু নিষেকে অংশ নিতে পারে না । তা ছাড়া, এনজাইমের প্রভাবে জোনা পেলুসিডা শুক্রাণু-গ্রাহক প্রোটিনগুলোও নষ্ট হয়ে যায়, ফলে কোনো শুক্রাণুই আর জোনা পেলুসিডায় যুক্ত হতে পারে না।
• শুক্রাণু প্রবেশের ফলে সেকেন্ডারি উওসাইটটি উদ্দীপ্ত হয়ে দ্বিতীয় মিয়োটিক বিভাজন (মিয়োসিস-২) ঘটিয়ে পরিণত ডিম্বাণু ও দ্বিতীয় পোলার বডি সৃষ্টি করে। দ্বিতীয় পোলার বডি দ্রুত ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং শুক্রাণুর লেজ ডিম্বাণুর সাইটোপ্লাজমে মিশে যায় । এ সময় শুক্রাণু-নিউক্লিয়াসে ক্রোমাটিনগুলো ঢিলে-ঢালা হয়ে পড়ে, ফলে নিউক্লিয়াসটি স্ফীত হয় । এ পর্যায়ে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু নিউক্লিয়াসকে যথাক্রমে পুরুষ ও স্ত্রী প্রোনিউক্লিয়াই (male and female pronuclei) বলে )
• পুরুষ প্রোনিউক্লিয়াসটি ডিম্বাণুর কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হয়ে স্ত্রী প্রোনিউক্লিয়াসের সাথে একীভূত হলে ডিম্বাণুটি ডিপ্লয়েড জাইগোটে (n + n = 2n) পরিণত হয়।
হ্যাপ্লয়েড় ভ্রুণ
ডিপ্লয়েড ভ্রুণ
পলিপ্লয়েড ভ্রুণ
কোনোটিই নয়
ইমপ্ল্যান্টেশন (Implantation):
নিষেকের পর ৬ থেকে ৯ দিনের মধ্যে যে প্রক্রিয়ায় জাইগোটটি ব্লাস্টোসিস্ট অবস্থায় জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়ামে (স্তন্যপায়ী প্রাণীর জরায়ুর অন্তর্গাত্রে অবস্থিত রক্তবাহিকা ও গ্রন্থিসমৃদ্ধ স্থূল মিউকাস ঝিল্লি) সংস্থাপিত হয় তাকে ইমপ্ল্যান্টেশন বলে।
নারীর ডিম্বাণু ডিম্বনালির (ফেলোপিয়ান নালি) উর্দ্ধপ্রান্তে নিষিক্ত হয়ে জাইগোটে পরিণত হয়। এটি দ্রুত বিভক্ত হয়ে মরুলা (morula) নামক একটি নিরেট কোষপুঞ্জের সৃষ্টি করে এবং ডিম্বনালির সিলীয় আন্দোলন ও ক্রমসংকোচনের ফলে নিম্নগামী হয় । জাইগোটের পর্যায়ক্রমিক মাইটোসিস বিভাজনকে ক্লিভেজ (cleavage) বলে। নিরেট কোষপুঞ্জটি ডিম্বনালি থেকে সংগৃহীত তরলে পূর্ণ অন্তঃস্থ গহ্বর (ব্লাস্টোসিল) সমন্বিত ও এককোষস্তরীয় ব্লাস্টোসিস্ট (blastocyst)-এ পরিণত হয়। ব্লাস্টোসিস্টে প্রায় ১০০টির মতো কোষ থাকে। প্রতিটি কোষকে ব্লাস্টোমিয়ার (blastomere) বলে। ব্লাস্টোমিয়ারের স্তরকে বলে ট্রফোব্লাস্ট (trophoblast)। ৪-৫ দিনের ভিতর ব্লাস্টোসিস্ট জরায়ুতে এসে পৌঁছালে দু'দিনের মধ্যে এর জোনা পেলুসিডা আবরণ অদৃশ হয়ে যায় । তখন ট্রফোব্লাস্ট কোষ ও জরায়ুর এন্ড্রোমেট্রিয়াম কোষের মধ্যে সংযোগ স্থাপিত হয়। ব্লাস্টোসিস্ট এন্ডোমেট্রিয়ামের যেখানে গ্রোথিত হবে সেখানকার আবরণি টিস্যু ট্রফোব্লাস্ট থেকে নিঃসৃত এনজাইমের প্রভাবে বিগলিত হয় । তখন ব্লাস্টোসিস্টটি সেখানে যুক্ত হয় । এভাবে নিষেকের ৬ষ্ঠ থেকে ৯ম দিনের মধ্যে নিষিক্ত ডিম্বাণু বা জাইগোটটি ব্লাস্টোসিস্ট অবস্থায় জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়ামে আবদ্ধ হয়। জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়ামে ব্লাস্টোসিস্টের গ্রোথিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে ইমপ্ল্যান্টেশন বলে।
মানব ভ্রূণের পরিস্ফুটন (Development of the Human Embryo):
নিষেকের পর জাইগোট (2n) যে প্রক্রিয়ায় পরিবর্তনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ শিশু বা লার্ভায় পরিণত হয় তাকে পরিস্ফুটন বলে । প্রতিটি সদস্যের পরিস্ফুটন প্রক্রিয়াকে ব্যক্তিজনিক পরিস্ফুটন (ontogenic development) বলা হয়। যে শাখায় জীবের ব্যাক্তিজনিক পরিস্ফুটন সম্বন্ধে অধ্যয়ন করা হয়, তাকে ভ্রূণবিদ্যা (embryology) বলে । জাইগোট থেকে ভ্রুণ সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে এমব্রায়োজেনেসিস (embryogenesis) বলে। ব্যক্তিজনিক পরিস্ফুটনের ধাপগুলো নিম্নরূপ
১. ক্লিভেজ (Cleavage) : যে প্রক্রিয়ায় জাইগোট মাইটোসিস বিভাজনের মাধ্যমে বিভাজিত হয়ে অসংখ্য ভ্রূণকোষ সৃষ্টি করে তাকে ক্লিভেজ বা সম্ভেদ বলে। ক্লিভেজে সৃষ্ট ভ্রূণের প্রতিটি কোষকে বলে ব্লাস্টোমিয়ার (blastomere)। ক্লিভেজ প্রক্রিয়ায় ক্রমাগত কোষ বিভাজনের ফলে জাইগোটটি বহুকোষী নিরেট গোলকে পরিণত হয়। এর নাম মরুলা (morula)। মরুলার কোষগুলো ক্রমশ একস্তরে সজ্জিত হয় এবং এর ভেতরে একটি তরলপূর্ণ গহ্বর সৃষ্টি হয়। ভ্রূণের এ দশাকে ব্লাস্টুলা (blastula) বলে। ব্লাস্টুলার প্রাচীরকে ব্লাস্টোডার্ম (blastoderm) এবং তরল পূর্ণ গহ্বরকে ব্লাস্টোসিল (blastocael) বলে। ভ্রূণ রাস্টুলায় পরিণত হওয়ার সাথে সাথে ক্লিভেজ দশার পরিসমাপ্তি ঘটে।
২. গ্যাস্ট্রুলেশন (Gastrulation) : ভূণে আর্কেন্টেরণ (archenteron) নামক প্রাথমিক খাদ্যগহ্বর বা আন্ত্রিকগহ্বর সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে গ্যাস্টুলেশন বলে। পরিস্ফুটনের এ ধাপে ব্লাস্টোডার্ম দুই বা তিনটি কোষস্তর নির্মাণ করে। এদের বলে ভ্রূণীয় স্তর (germinal layers)। এসব স্তর থেকে প্রাণিদেহের বিভিন্ন অঙ্গ গঠিত হয় । এ পর্যায়ে ভ্রূণীয় স্তরগুলোতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যায়, ফলে একটি অংশ ব্লাস্টোডার্মের পিঠেই রয়ে যায়। পরবর্তীতে একে এক্টোডার্ম নামে অভিহিত করা হয়। অন্য অংশ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মেসোডার্ম ও এন্ডোডার্ম-এ পরিণত হয়। কোষ পরিযানের (migration) কারণেই এসব হয়ে থাকে। এ প্রক্রিয়া শেষ হলে ভ্রূণ যে রূপ ধারণ করে তাকে গ্যালা (gastrula) বলে । এর ভেতরে যে গহ্বর থাকে তাকে আর্কেন্টেরণ (archenteron), আর গহ্বরটি যে ছিদ্রপথে বাইরে উন্মুক্ত থাকে, তাকে ব্লাস্টোপোর (blastopore) বলে ।
৩. অর্গানোজেনেসিস (Organogenesis) (গ্যাস্টলেশনে সৃষ্ট ভ্রূণীয় স্তরগুলো থেকে ভ্রূণের অঙ্গকুঁড়ি (organ rudiment) সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে অর্গানোজেনেসিস বলে । তিনটি ভ্রূণীয় স্তরেরই অভিন্ন কোষপিন্ড ছোটো ছোটো কোষগুচ্ছে বিচ্ছিন্ন হয় । প্রত্যেক গুচ্ছ প্রাণিদেহের নির্দিষ্ট অঙ্গ বা অংশ নির্মাণ করে । এসব কোষগুচ্ছকে একেকটি অঙ্গের কুঁড়ি বলে। (যে সব কুঁড়িতে ভ্রূণীয় স্তরগুলোর উপবিভক্তি ঘটে সেগুলোকে প্রাইমারি অঙ্গকুঁড়ি বলে । এদের কয়েকটি বেশ জটিল এবং এমন কতকগুলো কোষ নিয়ে গঠিত যারা একটি সম্পূর্ণ অঙ্গতন্ত্র গঠনেও সক্ষম । যেমন-সমগ্র স্নায়ুতন্ত্র কিংবা পৌষ্টিকতন্ত্র ইত্যাদি। প্রাইমারি অঙ্গকুঁড়ি আরও বিভক্ত হয়ে সেকেন্ডারি অঙ্গকুঁড়ি-তে পরিণত হয়। এসব কুঁড়ি থেকে উৎপন্ন হয় সেকেন্ডারি অঙ্গের।
ভ্রূণের বিকাশ (Development of Foetus ) নারীর ডিম্বাণু ফেলোপিয়ান নালির (ডিম্বনালি) ঊর্ধ্বপ্রান্তে নিষিক্ত হওয়ার পর তা জাইগোট -এ পরিণত হয়। জাইগোটটি দ্রুত বিভক্ত হয়ে মরুলা নামক একটি নিরেট কোষপুঞ্জের সৃষ্টি করে। এটি ফেলোপিয়ান নালির সিলীয় আন্দোলন ও ক্রমসংকোচনের ফলে ৬-৯ দিনের মধ্যে জরায়ুতে এসে পূর্বে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছায়। ততক্ষণে এটি ফাঁপা একস্তরীয় ব্লাস্টোসিস্ট পর্যায়ে উপনীত হয় এবং এর চারদিকের জোনা রেডিয়াটা স্তরটি ট্রিফোরাস্ট কোষস্তরে পরিণত
" জরায়ু-প্রাচীরের যেখানে ব্লাস্টোসিস্ট রোপিত হবে সেখানকার আবরণী টিস্যু ট্রফোরাস্ট নিঃসৃত এনজাইমের প্রভাবে বিগলিত হলে ব্লাস্টোসিস্ট নিমজ্জিত হয়। এর নিচে থাকে যোজক টিস্যুস্তর। ছিন্ন জরায়ু-প্রাচীর আবার নতুন করে সৃষ্টি হয় এবং ব্লাস্টোসিস্টকে ঢেকে দেয় ।
ট্রফোরাস্ট স্তরটি পরবর্তী পর্যায়ে নানা জটিল ধাপ অতিক্রম করে ভ্রূণের বয়স ২১ দিন শেষ হওয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তেই অমরা (placenta) সৃষ্টির মাধ্যমে ভ্রূণকে মাতৃদেহের টিস্যুর সাথে এক অভিন্ন বন্ধনে আবদ্ধ করে। মাতৃদেহ হতে ভ্রুণে এটি সরবরাহের জন্য সুম্মিলিতভাবে মাতৃটিস্যু ও ভূর্ণ গঠিত অঙ্গকে প্লাসেন্টা বা অমরা বলে। ভ্রুণ থেকে বর্জ্য পদার্থ অপসারণ, ভ্রূণের সুরক্ষা প্রদান, হরমোন ক্ষরণ, কিছু রোগের বিরুদ্ধে ভ্রূণদেহে প্রতিরোধ ব্যবস্থা সৃষ্টি করা ইত্যাদিও অমরার কাজ।
প্রথম দুই সপ্তাহে ভ্রূণে ভ্রূণীয় স্তর ও বহিঃভূণীয় ঝিল্লি (কুসুম থলি, অ্যামনিওন, অ্যালানটয়েস, কোরিয়ন প্রভৃতি)- র সৃষ্টি হয় এবং তৃতীয় সপ্তাহে অমরা ও নাভী রজ্জু (umbilical cord) গঠিত হয়। ততক্ষণে নিউরাল নালি ও দেহখন্ডও বিকশিত হয়। চতুর্থ সপ্তাহের শুরুতে রক্তবাহিকার সৃষ্টি হয়। পরে মস্তিষ্কের বহিবৃদ্ধিরূপে পেয়ালার মতো চোখের উৎপত্তি হয়। ভ্রূণের দৈর্ঘ্য ০.৫ সে.মি.।
পঞ্চম সপ্তাহে ভ্রুণ একটি জীবের আকৃতি প্রাপ্ত হয় কিন্তু দেখতে মানুষের মত নয়। তখন এর হাত-পা কুঁড়ি থাকারে থাকে, মাথা ও গলা সুস্পষ্ট এবং চোখ স্ফীত। এ সময়কার ভ্রূণে একটি লেজ এবং গলায় ফুলকারন্ধ্র থাকে।
প্রথম দুমাসের বাকী সময়গুলোতে (ষষ্ঠ-অষ্টম সপ্তাহ) হাত-পায়ের কুঁড়িগুলো শনাক্তপযোগী হাত ও পায়ে রূপান্তরিত হয়; ফুলকারন্ধ্র অদৃশ্য হয়; লেজ সংকুচিত হয়; মাথাটি স্ফীত হলে মুখমন্ডল মানুষের রূপ ধারণ করে; অস্থির আবির্ভাব ঘটে; এবং বেশির ভাগ অন্তঃস্থ অঙ্গ অগঠিত অবস্থায় পরিস্ফুটিত হয়। পরবর্তী সাত মাসে প্রধানত ভ্রূণের বৃদ্ধি ঘটে এবং উল্লিখিত অঙ্গগুলো পরিণত ও কার্যক্ষম হয়ে উঠে। তাই ভূগের সুষ্ঠু পরিস্ফুটনের জন্য প্রথম দুমাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।
তৃতীয় মাসে ভ্রূণের অঙ্গগুলো বেশ সুগঠিত হয়ে ওঠে। তখন সে জরায়ুর ভেতর নড়া-চড়া করে, পা দিয়ে লাথি দেয়, হাত দোলায়, মুখে ভাবভঙ্গি প্রতিফলিত হয় এমনকি, বৃদ্ধাঙ্গুলও চুষতে দেখা যায়।
চতুর্থ মাসে ভ্রূণ প্রায় ১৩ সে.মি. (৫ ইঞ্চি) লম্বা হয়, ওজন দাঁড়ায় ১৪১ গ্রামে (৫ আউন্সে)। এ পর্যায়ের মানব ভ্রূণকে ফিটাস (foctus) বলে।
পঞ্চম মাসে ভ্রূণের ওজন হয় প্রায় ২২৭ গ্রাম (আধ পাউন্ড)। তখন মাথায় চুল গজায়; স্টেথোস্কোপ-এর সাহায্যে হৃৎস্পন্দনও শোনা যায়; এবং অমরা জরায়ুর অধিক অংশ দখল করে নেয়।
ছয় মাস বয়সী ফিটাসের ওজন হয় ৬৮১ গ্রাম (দেড় পাউন্ড)। এমন অপরিণত অবস্থায় ভূমিষ্ঠ হলেও ফিটাসকে সযত্নে ইনক্যুবেটরে রেখে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে বাঁচানো যায় ।
পরবর্তী তিন মাসে (৭ম-৯ম) ফিটাস তার জন্মকালীন ওজন (৩.১৭-৩.৬২ কেজি বা ৭-৮ পাউন্ড) প্রাপ্ত হয়। এ সময় অমরা বিনষ্ট হতে থাকে; ফিটাসের রক্তপ্রবাহে অমরা ভেদ করে অ্যান্টিবডি প্রবেশ করে; মস্তিষ্কের বিপুল বৃদ্ধি ঘটে; এবং অনেক স্নায়ুর সৃষ্টি হয়। এ সময়টি ভ্রূণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তখন গর্ভবতীদের বেশি পরিমাণে প্রোটিন সমৃদ্ধ আহার গ্রহণ করতে হয়।
শিশু প্রসব (Birth of a baby):
নিষেকের পর ১০ সপ্তাহের মধ্যে বাহ্যিকভাবে ভ্রূণকে মানুষ হিসেবে শনাক্ত করা যায়। ভ্রূণের এ অবস্থাকে ফিটাস (foetus) বলে। জরায়ুতে ফিটাস প্রায় ৩৮ সপ্তাহ অবস্থান করে। এ সময়কালকে গর্ভধারণকাল (the gestation period) বলে। গর্ভধারণকালের প্রথম ১২ সপ্তাহের মধ্যেই প্রকৃতপক্ষে প্রধান অঙ্গসমূহের অধিকাংশ তৈরি হয়ে যায়।
শিশু প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণের জন্য ৩৮ সপ্তাহের সাথে ২ সপ্তাহ যোগ করে অর্থাৎ সর্বশেষ রজঃচক্রের প্রথম দিনের সাথে ৪০ সপ্তাহ যোগ করে সম্ভাব্য প্রসব দিন (Expected Delivery Date-EDD) নির্ধারণ করা হয়। তবে প্রসব ৫ দিন পূর্বে বা পরে হতে পারে।[কোন সন্তান সম্ভাব্য মহিলার সর্বশেষ রজঃচক্রের প্রথম দিন ১ম জানুয়ারি হলে তার সম্ভাব্য প্রসব দিন হবে অক্টোবর মাসের ০৭ তারিখ + - ৫ দিন ]
মানুষে গর্ভাবস্থা (pregnancy) কাল গড়ে ৪০ সপ্তাহ। গর্ভাবস্থায় ১২তম সপ্তাহে প্লাসেন্টা নিঃসৃত প্রোজেস্টেরন হরমোনের প্রভাবে জরায়ুর সংকোচন বন্ধ থাকে। গর্ভাবস্থায় রক্তে প্রোজেস্টেরনের মাত্রা বাড়তে থাকে তবে ৩৮তম সপ্তাহে রক্তে প্রোজেস্টরনের মাত্রা হঠাৎ করেই কমে যায় ফলে জরায়ু সংকোচনের প্রতিবন্ধকতা দূর হয়। একই সাথে মাতার অগ্রপিটুইটারী গ্রন্থি থেকে অক্সিটসিন (oxytocin) এবং প্লাসেন্টা থেকে প্রোস্টাগ্লান্ডিন (prostaglandin ) হরমোন ক্ষরণ শুরু হয়।
৪০তম সপ্তাহে হরমোনদ্বয়ের সক্রিয়তায় জরায়ুর সংকোচন ঘটে। এ সংকোচনের ফলে শিশু চায়ু থেকে বাইরে আসতে পারে । প্রক্রিয়াটি তিনটি ধাপে সংঘটিত হয়, যথা-
১. জরায়ু মুখ (cervix) ১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত প্রসারিত হয়।
২. ফিটাস জরায়ু থেকে বাইরে আসে এবং ৩. প্লাসেন্টা ও নাভীরজ্জু বা আমবিলিক্যাল কর্ড (umbilical cord) (ফিটাস থেকে প্লাসেন্টা পর্যন্ত আমবিলিক্যাল ধমনি ও শিরা বনহকারী অঙ্গকে নাভীরজ্জু বলে) জরায়ুর অভ্যন্তর থেকে বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়।
গর্ভাবস্থা ও পরিচর্যাঃ গর্ভে সন্তান ধারণকারী মাকে গর্ভবতী (pregnant) বলা হয়। গর্ভাবস্থায় মায়ের পরিচর্যায় পালনীয় বিষয়গুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
অন্তঃসত্ত্বা অবস্থার শুরতেই চিকিৎসককে দিয়ে পরীক্ষা করানো ও তাঁর উপদেশ নেয়া উচিত। প্রথম পরীক্ষার পর ২৮ সপ্তাহ পর্যন্ত মাসে একবার, ২৯-৩৬ সপ্তাহ পর্যন্ত মাসে দুবার ও ৩৭ সপ্তাহ থেকে প্রসব না হওয়া পর্যন্ত সপ্তাহে একবার পরীক্ষা করানো উচিত। এ ছাড়াও কখনো কোনো সমস্যা দেখা দিলে নির্ধারিত দিনের আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
ক. চিকিৎসা সংক্রান্ত পরিচর্যা
খ. গর্ভাবস্থায় অন্যান্য পালনীয় বিষয়
১. খাদ্য : গর্ভবতী মায়ের পুষ্টির উপরই নির্ভর করে গর্ভস্থ শিশুর বৃদ্ধি, বিকাশ ও ভবিষ্যৎ জীবনে ভালো থাকা। | তাই সুষম সহজপাচ্য ও সঠিক পরিমাণ আহার প্রয়োজন। গর্ভাবস্থায় সুষম আহার বলতে বোঝায় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বেশি পরিমাণ প্রোটিন, সঠিক পরিমাণ শর্করা ও কম পরিমাণ চর্বি জাতীয় খাদ্যের সঙ্গে উপযুক্ত পরিমাণ লৌহ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ও অন্যান্য পদার্থ, যথা- জিঙ্ক, ফলিক এসিড, পটাসিয়াম, সেলেনিয়াম প্রভৃতি। সম্ভব হলে দিনে ১ লিটার দুধ, ১ বা ২ টুকরা মাছ বা মাংস, ১টি ডিম, ১টি বা ২টি ঋতুকালীন ফল, টাটকা শাকসব্জি এবং ভাত ও ডাল পেট ভরে খাওয়া উচিত। নিরামিষভোজীদের দুধের পরিমাণ বাড়াতে হয়। তা ছাড়া অঙ্কুরিত ছোলাও খাদ্য তালিকায় যোগ করা উচিত । প্রতিদিন ৬-৮ গ্লাস ফোটানো পানি খাওয়া প্রয়োজন।
২. কোষ্ঠকাঠিন্য : গর্ভাবস্থায় কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রবণতা থাকে। এর সমাধানকল্পে বেশি পরিমাণ শাকসব্জি খাওয়া দরকার। তা ছাড়া শুকনো খেজুর ও বীট খাবার তালিকায় রাখা উচিত।
৩. দাঁত : গর্ভাবস্থায় দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণের সম্ভাবনা থাকে। তাই এ সময় দাঁত না তোলাই ভাল ।
৪. বিশ্রাম : গর্ভাবস্থায় পরিমিত বিশ্রাম দরকার। দুপুরে দুঘন্টা, রাতে আটঘন্টা বিশ্রাম নেওয়া উচিত। সব সময় পাশে কাত হয়ে শোয়া উচিত। এতে শিশুর বিকাশ স্বাভাবিক হয়।
৫. কাজকর্ম : স্বাভাবিক কাজকর্মে বাধা নেই, তবে ভারী কাজকর্ম করা একেবারেই উচিত নয়। ৬. গোসল : রোজ গোসল করে শরীর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। গোসল করার সময় যেন পিছলে পড়ে না যায় সেদিকে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে।
৭. কাপড় : গর্ভাবস্থায় ঢিলেঢালা কাপড় পড়া উচিত। বাংলাদেশের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে সুতীর কাপড়-চোপড় পড়া স্বাস্থ্যসম্মত।
৮. ভ্রমণ : ঝাঁকুনিযুক্ত ক্লান্তিকর ভ্রমণ গর্ভাবস্থার প্রথম তিন মাস ও শেষ দুমাস না করাই ভালো। বাসের চেয়ে রেল বিমানে ভ্রমণ-ঝুঁকি অনেক কম।
৯. ধুমপান ও মদ্যপান : গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ধূমপান ও মদ্যপান অনুচিত। তা না হলে কম ওজনের শিশু কিংবা বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে।
১০. যৌনমিলন : গর্ভের প্রথম তিন মাস ও শেষ দেড় মাস যৌন মিলন থেকে বিরত থাকা উচিত। এতে গর্ভপাত অকাল প্রসব ও সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে।
গর্ভনিরোধক পদ্ধতিঃ
সন্তানের জন্ম বিভিন্ন উপায়ে রোধ করা সম্ভব। বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকরা গর্ভনিরোধকের নানা পদ্ধতি নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন। বর্তমান সময়ে যেসব গর্ভনিরোধক পদ্ধতি অনুসৃত হয় সে সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো । গর্ভনিরোধক সকল ব্যবস্থাকে প্রধানত দুই শ্রেণিভুক্ত করা যায়, অস্থায়ী পদ্ধতি এবং স্থায়ী পদ্ধতি
ক. অস্থায়ী পদ্ধতি (Temporary Methods)
শারীরিক প্রদ্ধতি : গর্ভনিরোধকের শারীরিক পদ্ধতি হচ্ছে নিরাপদ সময় নির্বাচন ও শিশ্ন বহিষ্করণ ঃ → নিরাপদ সময় নির্বাচন : মাসিক রজঃচক্রের প্রথম ও শেষ সপ্তাহের দিনগুলোতে ফেলোপিয়ান নালিতে। কোন পরিপক্ক ডিম্বাণু থাকে না বলে ঐ সময়কে যৌনমিলনের নিরাপদ সময় বলে।
শিশু বহিষ্ককরণ : সঙ্গমকালে শুক্রাণু স্খলনের মুহূর্তে যদি শিশুকে প্রত্যাহার করে দেহের বাইরে স্খলিত করা হয় তা হলে শুক্রাণু নিষেক ক্রিয়ায় অংশ গ্রহণ করতে পারে না।
রাসায়নিক পদ্ধতি : শুক্রনাশক জেলি, ক্রীম, ফেনা বা ফোম বড়ি, জেল প্রভৃতি বিশেষ ধরনের রাসায়নিক পদার্থ যৌনমিলনের আগে স্থাপন করতে হয়। এটি ২০-৩০ মিনিট পর্যন্ত কার্যক্ষম থেকে স্খলিত শুক্রাণুকে বিনষ্ট করে দেয়।
যান্ত্রিক পদ্ধতি : জন্মনিরোধক হিসেবে বেশ কয়েক ধরনের যান্ত্রিক পদ্ধতি রয়েছে :
কনডম : এটি পুরুষের ব্যবহারের জন্য এক ধরনের পাতলা, লম্বাটে রবারের থলি। সঙ্গমের পূর্বে শি কনডমে আবৃত করে নিলে স্খলিত শুক্রাণু আর জরায়ুতে প্রবেশ করতে পারে না।
ডায়াফ্রাম : এটি মিলনের পূর্বে জেলি বা ফোম সহযোগে স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিৎসকের সহায়তায় যোনিতে স্থাপন করতে হয় এবং যৌন মিলনের পর অন্ততঃ ৬ ঘন্টা সেখানেই রাখতে হয়। ডায়াফ্রাম ব্যবহারে কোন স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই, বরং জরায়ুর ক্যান্সার এবং কিছু যৌন রোগ প্রতিরোধ সহায়ক। স্পঞ্জ এটি ভিজিয়ে যোনিতে স্থাপন করতে হয় এবং পর মুহূর্ত থেকেই কার্যক্রম হলে ২৪ ঘন্টা অনবরত প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকে।
অন্তর্জরায়ু গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা : এ ব্যবস্থায় পলিথিন, তামা, রূপা বা স্টেনলেস স্টীল নির্মিত একটি ফাঁস (loop) জরায়ুর অভ্যন্তরে স্থাপন করলে তা জরায়ুর ভেতরে নিষিক্ত ডিম্বাণুর রোপনে বাধা দান করে।
শারীরবৃত্তীয় পদ্ধতি : এ ব্যবস্থার প্রধান উপকরণ জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ও ইনজেকশন।
জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি : এটি বিভিন্ন অনুপাতে এস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরণের মিশ্রণে তৈরি এবং মুখে গ্রহণযোগ্য বড়ি। রজঃচত্রের ৫-২৫তম দিন পর্যন্ত প্রতিদিন একটি করে বড়ি গ্রহণ করতে হয়। এগুলো মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাসের উপর কাজ করে ডিম্বপাতে বাধা দেয় এবং জরায়ুকণ্ঠের মিউকাস ঝিল্লিকে শুক্রাণু প্রবেশের বিরোধী করে তোলে। এটি একটি বহুল প্রচলিত জন্মনিরোধক পদ্ধতি কিন্তু অনেক মহিলার সাময়িক বমি বমি ভাব, ফোঁটা ফোঁটা স্রাব, উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধির মত উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
ইনজেকশন : বেশ কয়েকমাস যাতে গর্ভধারণ ঝুঁকি নিরাপদে এড়ানো যায় তার জন্য ইদানিং এক ধরনের ইনজেকশন আবিষ্কৃত হয়েছে। অনেক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকায় এর গুণগত মান উন্নয়নের চেষ্টা চলছে। ৫. গর্ভপাত : অস্ত্রোপচারের সাহায্যে ২-৩ মাস বয়সী ভ্রূণকে বিচ্যুত করিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ করা যায়।
খ. স্থায়ী পদ্ধতি (Permanent Methods): জন্মনিরোধের জন্য স্থায়ী পদ্ধতি অবলম্বন করাকে বন্ধ্যাকরণ (sterilisation) বলে। এটি নিচে বর্ণিত দুধরনের।
১. ভ্যাসেকটমি (Vasectomy) : এ পদ্ধতিতে পুরুষের ক্ষেত্রে উভয় দিকের শুক্রনালির অংশকে কেটে বেঁধে দেয়া যাতে শুক্রাণু বাইরে আসতে না পারে।
২. টিউবেকটমি (Tubectomy) বা লাইগেশন (ligation) : এ পদ্ধতিতে মহিলাদের ক্ষেত্রে উভয় দিকের সাপিয়ান নালির অংশ কেটে বেঁধে দেয়া হয় যাতে শুক্রাণু প্রবেশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। অধিক সন্তানবতী বা যাঁরা কেবারেই আর সন্তান চান না বা গর্ভধারণের জন্য শারীরিকভাবে অসুস্থ তাঁদের জন্য এ পদ্ধতি গ্রহণ করা প্রয়োজন ।
পরিবার পরিকল্পনা (Family Planning):
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা আজ নানা কারণে ভয়াবহ অনুভূত হচ্ছে। তাই সমগ্র পৃথিবীতে প্রতিটি দেশে জনসংখ্যা নিয়ণের কার্যক্রম জোরদার করে একে আয়ত্তে আনবার প্রচেষ্টা চলছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে উদ্ভূত সমস্যাগুলো চিহ্নিত - ভন্তে পারলেই আমরা পরিবার পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তাও সহজেই বুঝতে পারব। জনবহুলতার ফলে উদ্ভূত সমস্যাগুলো হচ্ছে : খাদ্যের অপ্রতুলতা; বস্ত্রের অপর্যাপ্ততা; উপযুক্ত বাসস্থানের অভাব; সুচিকিৎসার অভাব; পরিবেশ নামের ফলে বিশুদ্ধ পেয় পানির এমনকি কোন কোন অঞ্চলে বিশুদ্ধ বাতাসের অভাব; শিক্ষার অভাব; অপূরণীয় খনিজ পদের বর্ধিত হারে উত্তোলন ও ব্যবহার; অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততা; বেকারত্ব বৃদ্ধি; এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা।
উপরোক্ত সমস্যাগুলোর সমাধানের উদ্দেশ্যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এক কথায় বলতে গেলে, মানব জাতিকে টিকিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণে অনতে হবে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপায়ঃ প্রত্যেকটি দেশই অনন্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে মন্ডিত। যে কোন বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের আগে এ দিকটি খতিয়ে দেখতে হয়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকেও প্রত্যেক দেশের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বিবেচনা। করা উচিত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উপায়গুলো নিম্নোক্ত ধরনের হতে পারে :
বিয়ের বয়স : নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে বিয়ের বয়স নির্ধারিত থাকবে এবং আইন লংঘনকারীদের উপযুক্ত শাস্তির বিধান থাকবে।
সন্তান সংখ্যা : দম্পতি পিছু "এক সন্তানই যথেষ্ট” এ শ্লোগান কার্যকর করতে হবে।
বিবাহ বন্ধনের নিয়মকানুন : বিভিন্ন ধর্মমতের বিবাহ পদ্ধতিকে উৎসাহিত করতে হবে। কোথাও বহুবিবাহ সিদ্ধ থাকলে সেক্ষেত্রে সন্তানসংখ্যা সম্পর্কে কঠোর আইন এবং আইন লংঘনকারীর উপযুক্ত শাস্তির বিধান করতে হবে।
শিক্ষা : প্রাথমিক পর্যায় থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল সম্বন্ধে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে এবং প্রত্যেক দম্পতিকে জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। এজন্য দক্ষ মাঠকর্মী নিয়োগ ও অদক্ষদের ছাঁটাই করতে হবে।
গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা : কাঙ্খিত সন্তানসংখ্যা ও তা নির্দিষ্ট বয়স অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সক্ষম দম্পতিদের স্থায়ী গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য করাতে হবে। এ বিষয়ে গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও শহরের। ওয়ার্ড কমিশনারদের জবাবদিহিতার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা : নির্ধারিত সময়ের পর বিয়ে এবং এক সন্তান / দুই সন্তানবিশিষ্ট পরিবারকে লেখাপড়া, ভ্রমণ ও চাকুরীতে বিশেষ সুযোগের ব্যবস্থা করতে হবে।
আইভিএফ পদ্ধতি (IVF-In Vitro Fertilization Process)-কৃত্রিম গর্ভধারণঃ
সাধারণত নারীদেহের অভ্যন্তরে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু নিউক্লিয়াসের একীভবনের মধ্য দিয়ে নিষেক সম্পন্ন হয় । নিষিক্ত ডিম্বাণুটি গর্ভাশয়ের প্রাচীরে সংস্থাপিত হয়ে প্রায় ৯ মাস পর পরিস্ফুটন শেষে একটি শিশুসন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। এ প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক গর্ভধারণ (natural conception) নামে পরিচিত। ডিম্বনালি বন্ধ হয়ে গেলে, ক্ষত হলে বা এন্ডোমেট্রিওসিস ছাড়াও পুরুষের ক্ষেত্রে শুক্রাণুর সংখ্যা কম হলে বা অস্বাভাবিক গড়নের শুক্রাণু হলে, অথবা নারী ও পুরুষ উভয় থেকে শুক্রাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হলে, নারীতে ডিম্বপাত না হলে IVF গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। তখন দেহের বাইরে গবেষণাগারে কাচের পাত্রে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলন ঘটিয়ে নিষিক্ত ডিম্বাণুকে জরায়ুতে স্থাপন করে গর্ভধারণ করানোর ব্যবস্থা করা হয়। এ প্রক্রিয়ার নাম ইন ভিট্রো নিষেক (In Vitro Fertilization, সংক্ষেপে IVF) প্রক্রিয়া। ‘in vitro’ একটি ল্যাটিন শব্দ, এর অর্থ হচ্ছে কাচের ভিতরে (within the glass)। প্রক্রিয়াটি টেস্ট টিউব পদ্ধতি এবং ভূমিষ্ঠ শিশুটি টেস্ট টিউব বেবী নামে সাধারণভাবে প্রচলিত। ১৯৭৮ সালের ২৫ জুলাই লন্ডনের ওল্ডহ্যাম জেনারেল হসপিটালে প্যাট্রিক স্টেন্টো (Patric steptoe, 1913-1988) এবং রবার্ট জি. এডওয়ার্ডস (Robert G. Edwards, 1925-2013) এর তত্ত্বাবধানে জন্ম নেয় বিশ্বের সর্বপ্রথম টেস্ট টিউব বেবী লুইস ব্রাউন (Louise Joy Brown) নামের কন্যা শিশুটি। বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসায় এ অনন্য অবদানের জন্য তাকে ২০১০ সালে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। বাংলাদেশে প্রথম টেস্ট টিউব বেবীর Louise Joy Brown জন্ম হয় ২০০১ সালে।
আইভিএফ পদ্ধতির ধাপসমূহ (Steps to the IVF procedure):
আইভিএফ পদ্ধতি ছাড়া আর কোনও উপায়ে গর্ভধারণ সম্ভব নয় নিশ্চিত হলে যে কোনো দম্পতি প্রশিক্ষিত ও আধুনিক হাসপাতাল বা ক্লিনিকে গিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে পারেন। সব চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রায় একই ধরনের চিকিৎসা সম্পন্ন হয়ে থাকে। নিচে এ ধাপগুলো সম্বন্ধে সংক্ষেপে সাধারণ ধারণা দেয়া হলো।
ধাপ-১. স্বাভাবিক রজঃচক্র দমন : IVF-এর প্রথম ধাপে স্ত্রীর স্বাভাবিক রজঃচক্র দমিয়ে রাখতে একটি ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। ওষুধটি ইনজেকশন হিসেবে কিংবা নাকের ভিতর স্প্রে করে দেয়া হয়।
ধাপ-২. ডিম্বাণুর সরবরাহ বৃদ্ধি : নারীদেহে সাধারণত প্রতিমাসে একটি করে ডিম্বাণু পরিণত (mature) হয়. কিন্তু কৃত্রিম গর্ভধারণের ক্ষেত্রে একাধিক ডিম্বাণুর প্রয়োজন হয় কারণ একটিমাত্র ডিম্বাণু নিয়ে পূর্ণ-চিকিৎসা সম্পন্ন করার ঝুঁকি নেয়া ঠিক নয়। এ কারণে ডিম্বাণুর উৎপাদন বাড়াতে FSH (Follicle Stimulating Hormone) নামে হরমোনযুক্ত ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বেশি ডিম্বাণু উৎপাদিত হলে বেশি ডিম্বাণু নিষিক্ত করে যাচাই-বাছাইয়ে সুবিধা হবে। এভাবে ডিম্বাশয়কে বেশি ডিম্বাণু উৎপাদনে উদ্দীপ্ত করা হয়।
ধাপ-৩. অগ্রগতি পরীক্ষা : ডিম্বাণু উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য দ্বিতীয় ধাপে প্রয়োগিত হরমোনের ফলাফল পরীক্ষা করা হয় তৃতীয় ধাপে। এ জন্য আন্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান (বা ছবি) ও হরমোনের মাত্রা যাচাইয়ের জন্য রক্ত ও মূত্র পরীক্ষা করা হয়।
ধাপ-৪. ডিম্বাণু সংগ্রহ : ডিম্বাণু সংগ্রহের ৩৪-৩৮ ঘন্টা আগে ডিম্বাণু পরিপক্কতায় সাহায্য করতে আর হরমোন ইনজেকশন দেয়া হয় । ডিম্বাণু চোষক (follicular aspiration) প্রক্রিয়ায় নারীদেহের ডিম্বাশয় থেকে বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে পরিপক্ক ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হয়। এর আগে অবশ্য ব্যথানাশক ওষুধ খাওয়ানো হয়। আল্ট্রাসাউন্ড ছবির সূত্র ধরে যোনি পথে একটি সূক্ষ্ম ফাপা উঁচ প্রবেশ করিয়ে ডিম্বাশয় ও ফলিকলে (ডিম্বথলিতে) আবৃত ডিম্বাণুর কাছে নিয়ে যাওয়া হয় । সুঁচটি চোষক যন্ত্রের সঙ্গে লাগানো থাকে। এ যন্ত্র ডিম্বাশয়ের ফলিকল থেকে সামান্য তরলসহ ডিম্বাণু সংগ্রহ করে। এভাবে একটি একটি করে সুস্থ ও পরিপক্ক ডিম্বাণু সংগৃহীত হয়। একটি ডিম্বাণু সংগ্রহের পর সেটি নির্ধারিত পাত্রে রেখে আবার আরেকটি ডিম্বাণু সংগ্রহ করা হয়। প্রত্যেক ডিম্বাশয় থেকে পর্যাপ্ত পরিপক্ক ডিম্বাণু সংগ্রহের পর পূর্ব পর্যন্ত পরিবেশবান্ধব নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রায় (নারীদেহের সমান তাপমাত্রায়) সংরক্ষিত থাকে।
ধাপ-৫. শুক্রাণু সংগ্রহ : নারীর ডিম্বাণু সংগ্রহের সময়কালে পুরুষ সঙ্গীকে শুক্রাণু দানের জন্য আহ্বান জানানো হয়। শুক্রাণু সংগ্রহের পর কিছু সময়ের জন্য কালচার মিডিয়ামে জমা রাখা হয়। এর পর তা বিশেষ প্রক্রিয়ায় বীর্যরস পরিষ্কার করে দ্রুতগতিতে ঘূর্ণনের মাধ্যমে সুস্থ ও সক্রিয় শুক্রাণু নির্বাচন করা হয়।
ধাপ-৬. ডিম্বাণু নিষিক্তকরণ : গবেষণাগারে ইনকুবেটরে রাখা সর্বোচ্চ গুণগত মানের শুক্রাণু ও ডিম্বাণকে নিষেকের জন্য একসঙ্গে ১৬-২০ ঘন্টা পেট্রিডিশ বা কাচের টিউবে রেখে দেয়া হয়। প্রত্যেক ডিম্বাণুর জন্য প্রায় একলক্ষ শুক্রাণুর ব্যবস্থা রাখা হয়। এরপর পরীক্ষা করে দেখা হয় কোনো ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়েছে কিনা। নির্ধারিত সময় পর যদি নিষেক না ঘটে থাকে তখন বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে একটি ডিম্বাণুর ভিতরে একটি শুক্রাণুর প্রবেশ ঘটিয়ে নিষেকের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ প্রক্রিয়ার নাম অন্তঃসাইটোপ্লাজমিক শুক্রাণু ইনজেকশন (intracytoplasmic sperm injection সংক্ষেপে ICSI)। নিষেক ঘটেছে এবং ক্লিভেজ (বিভাজন) শুরু হয়েছে এমন অবস্থা দেখা দিলেই নিষিক্ত ডিম্বাণকে ভ্রূণ হিসেবে অভিহিত করা হয়।
ধাপ-৭. ভ্রূণ স্থানান্তর : নিষিক্ত ডিম্বাণু সংগ্রহের পর ১-৬ দিনের মধ্যে (সাধারণত ২-৩ দিনের মধ্যে) নারীর জরায়ুতে স্থানান্তর করা হয়। এ সময়ের ভিতর নিষিক্ত ডিম্বাণু ২-৪ ব্লাস্টোমিয়ার বিশিষ্ট ভুণে রূপ নেয়। একটি সুস্থ, সক্রিয় বিভাজনশীল ভ্রূণকে ক্যাথেটারের সাহায্যে আন্ট্রাসাউন্ড প্রতিচ্ছবি দেখে গর্ভাশয়ে সাবধানে স্থাপন করা হয়। এটি একটি ব্যথাহীন প্রক্রিয়া, তবে কেউ পেশিতে সামান্য খিল ধরায় আক্রান্ত হতে পারে। ভ্রূণ যদি জরায়ু অর্থাৎ গর্ভাশয়ে সংস্থাপিত হয় তাহলে গর্ভসঞ্চার হয়েছে বলে মনে করা হয়। এরপর ১০ মিনিট থেকে ৪ ঘন্টার মধ্যে গর্ভবতী বাসায় চলে যেতে পারেন। কেউ একাধিক ভ্রূণ গর্ভাশয়ে সংস্থাপন করতে পারেন। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যগত অবস্থা, বয়স প্রভৃতি বিশেষ বিবেচনায় নিতে হয়। অনেকে একটি ভ্রূণ সংস্থাপিত হওয়ার পর বাকি ভ্রূণগুলোকে গবেষণাগারে ভবিষ্যতে সংস্থাপনের জন্য, কেউবা অন্য কাউকে দান করার জন্য গবেষণাগারে বিশেষ প্রক্রিয়ায় জমা রাখেন। সংস্থাপনের পরবর্তী সময়কালটি সুনির্দিষ্ট নজরদারির মধ্যে থাকতে হয়। কারণ IVF পদ্ধতিতে জীবিত সন্তান জন্মদানের হার খুব বেশি নয়।
যেসব কারণে আই.ভি.এফ ব্যর্থ (Reasons why IVF fails)
সাধারণত স্ত্রীর বয়স, শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর গুণগত মান, প্রজনন অক্ষমতার মেয়াদকাল, জরায়ুর স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভরশীল হলেও বিভিন্ন কারণে আইভিএফ সফলতা পায়না :
1.ডিম্বাশয়ে ডিম্বাণুর পরিপক্কতার জন্য যে সময় প্রয়োজন সে সম্পর্কে ভুল অনুমান।
2.ডিম্বাণু পরিণত হওয়ার আগেই পৃথক করা।
3.পৃথকীকরণের সময় ডিম্বাণু নষ্ট হলে ।
4.নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে ভ্রূণের বিকাশ না হওয়া।
5.ভ্রূণের ত্রুটিপূর্ণ প্রতিস্থাপন।
6.ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির ত্রুটির কারণে আই.ভি.এফ ব্যর্থ হয়।
আই.ভি.এফ পদ্ধতিতে স্বাভাবিক বংশানুক্রমিক ধারাবাহিকতাও কিছু ক্ষেত্রে ক্ষুন্ন হয়। শুক্রাণু, ডিম্বাণু ও একটি জরায়ু হলেই এ পদ্ধতিতে গর্ভধারণ সম্ভব। আজকাল দেখা যায় যে, জরায়ুতে সমস্যা থাকলে, স্বামী-স্ত্রী নিজেদের শুক্রাণু-ডিম্বাণু দিয়ে তৈরি জ্বণ অন্য কোনো নারীর জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করছেন। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে আগত শিশুর মানসিকতা। বয়সের সঙ্গে মা-বাবার পরিচয় নিয়েও তার মনের ভিতর সংশয় তৈরি হতে পারে । কৃত্রিম পরিবেশে ভ্রূণ সংরক্ষণ করার সময় ভ্রূণের সাথে অপ্রাকৃতিক রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণ ঘটানোর ফলে গবেষণার উদ্দেশ্যে জ্বণের অপব্যবহারের শঙ্কা থাকে। তাছাড়া ভ্রূণকে পণ্যের মতো ব্যবহারের শঙ্কা রয়েই যায়। এত সবের পরও থেমে নেই আই ভি,এফ পদ্ধতিতে শিশুর জন্ম । সন্তান ধারণের মাঝ দিয়ে নারী পায় তার পূর্ণতা । তাই প্রজনন সংক্রান্ত প্রতিকূলতার কাছে নতি স্বীকার করতে রাজি নন প্রজননে অক্ষম পুরুষ ও নারীকুল। মাতৃত্বের আকাঙ্খা পূরণে আই.ভি.এফ পদ্ধতি তাদের কাছে আশীর্বাদস্বরূপ।
প্রথম টেস্টটিউব কুকুরের জন্ম (Birth of the first test-tube dog) :
যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক গত ০৯/১২/২০১৫ তারিখে। আইভিএফ পদ্ধতিতে সাতটি কুকুরছানার জন্ম দেয়ার কথা ঘোষণা করেন। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে এসব গবেষকেরা একটি কুকুরীর জরায়ুতে ১৯টি ভ্রূণ স্থাপন করে এ সাফল্য পান। বিজ্ঞানীদের এ সাফল্যের প্রভাব সুদূর প্রসারী হতে পারে। কারণ এ আইভিএফ পদ্ধতি ব্যবহার করে বিলুপ্তপ্রায় বিভিন্ন প্রাণী সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার সুযোগ তৈরি হবে।
বাংলাদেশ প্রেক্ষিত (Bangladesh Perspective) :
বাংলাদেশে প্রথম ত্রয়ী টেস্টটিউব বেবি হিসেবে জন্মগ্রহণ করে হীরা, মনি ও মুক্তা। এদের জন্ম হয় ২০০১ সালের ৩০ মে। এদের পিতা ও মাতা যথাক্রমে আবু হানিফ এবং ফিরোজা বেগম। এ দম্পতি Bangladesh Assisted Conception Center (BACC) and Women’s Hospital (WH), ঢাকা এর Dr. Fatema Parveen এর তত্ত্বাবধায়নে ১৯৯৪ সাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে ৬ বছর পর সন্তানত্রয় জন্মদানে সক্ষম হন। বর্তমানে বাংলাদেশে এ প্রযুক্তি নিয়ে সাফল্যজনকভাবে কাজ চলছে।বেসরকারীভাবে বেশ কয়েকটি আই.ভি.এফ সেন্টার রয়েছে।
আইভিএফ-এর সুবিধা (Advantages of IVF) :
এতে মাতৃত্বের বাসনা পূর্ণ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এটি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ও সহজ পদ্ধতি। ডিম্বনালি ক্ষতিগ্রস্ত থাকলেও গর্ভধারণ সম্ভব। এর দীর্ঘস্থায়ী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।
আইভিএফ-এর অসুবিধা (Disadvantages of IVF):
বেশিবার গর্ভধারণে গর্ভপাতের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এতে শিশুর অকাল জন্ম হতে পারে। এটি ব্যয় সাপেক্ষ চিকিৎসা। ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হতে পারে। মানসিক চাপে স্নায়বিক দৌর্বল্য দেখা দিতে পারে। টেস্ট টিউব শিশুদের বিকলাঙ্গতা ও বিরল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে বলে বিজ্ঞানীগণ প্রমাণ করেছেন। ডিম্বাণু সংগ্রহের সময় ডিম্বাশয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে রক্তক্ষরণ ও পরবর্তীতে জীবাণুর সংক্রমণ ঘটতে পারে। অনেকে টেস্ট টিউব বেবি নেয়াকে অনৈতিক মনে করেন কেননা এ পদ্ধতিতে অনেক ভ্রূণ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
পুরুষে প্রজননিক সমস্যার কারণ (Cause of Male Infertility): দম্পতির পুরুষ সদস্যে প্রজননিক সমস্যার মূলে রয়েছে নিচে বর্ণিত শুক্রাণুগত বিশৃঙ্খলা।
১. বীর্যে শুক্রাণুর অনুপস্থিতি (Absence of sperm) : (বীর্যে শুক্রাণুর অনুপস্থিতিকে অ্যাজোস্পার্মিয়া (azoospermia) বলে। শুক্রাণু উৎপাদন না হওয়া বা কোন প্রতিবন্ধকতার কারণে বীর্যে শুক্রাণু অনুপস্থিত থাকতে পারে।
২. বীর্যে শুক্রাণু সংখ্যার স্বল্পতা (low sperm count) : (বীর্যে শুক্রাণু সংখ্যার স্বল্পতাকে অলিগো স্পার্মিয়া (oligospermia) বলে )প্রতি কিউবিক সেন্টিমিটার বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা ২০ মিলিয়নের কম। অলিগোস্পার্মিয়ার নির্দিষ্ট কোন কারণ জানা নেই।
৩. শুক্রাণুর অস্বাভাবিকততা (Abnormal sperm) : অনেক শুক্রাণু ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছতে বা নিষেক ঘটাতে অক্ষম। দুটি লেজ থাকা, লেজবিহীন, মস্তকবিহীন বা অস্বাভাবিক আকৃতি ইত্যাদি হলো শুক্রাণুর অস্বাভাবিকতা ।
৪. অটোইম্যুনিটি (Autoimmunity) : নিজের শুক্রাণুর প্রতি বিশেষ ইমান প্রতিক্রিয়া ৫-১০% পুরুষ বন্ধ্যাত্বের বণ। রকে শুক্রাণু প্রতিরোধী আয়ন থাকা এক ধরনের ইম্যুন প্রতিক্রিয়া।
৫. শুক্রাণুর অকালপতন (Premature ejaculation) : নারী যৌনাঙ্গের অভ্যন্তরে পুরুষ যৌনাঙ্গ প্রবেশের আগেই কোণুর পতন ঘটে। অভিজ্ঞতা ও অভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য এ অবস্থা কাটিয়ে উঠা সম্ভব।
৬. পুরুষত্বহীনতা (Impotence) : যৌনাঙ্গের দৃঢ়তা রক্ষায় ব্যর্থতাও অন্যতম প্রজননিক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। তবে উপযুক্ত মনোবৈজ্ঞানিক উপদেশ এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সহায়ক হতে পারে।
নারীতে প্রজননিক সমস্যার কারণ (Cause of Female Infertility): নারীদেহে যে সব কারণে প্রজননিক সমস্যা দেখা যায় তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ নিচে বর্ণনা করা হলো।
১. ডিম্বপাতে ব্যর্থতা (Failure to ovulation) : প্রায় ১০% নারী ডিম্বপাতে ব্যর্থ বলে প্রজননিক বিষয়েও বিফল হয়। ডিম্বপাতে ব্যর্থ হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে হরমোনঘটিত। কখনও হাইপোথ্যালামাস বা পিটুইটারি গ্রন্থি স্বাভাবিকভাবে হরমোন ক্ষরণে ব্যর্থ হয় ফলে ডিম্বাণুর ফলিকল (ডিম্ব থলি) পরিস্ফুটিত হয় না, ডিম্বপাতও ঘটে না। অন্যদিকে, ডিম্বাশয় থেকে স্বাভাবিক হরমোনগুলো ক্ষরিত না হওয়ায় কিংবা ডিম্বাশয় ক্ষতিগ্রস্ত হলে নির্ধারিত হরমোন ক্ষরিত হয় না বলে ডিম্বপাত ঘটে না। তবে খুশির কথা এই যে ৯০% ক্ষেত্রে হরমোন ক্ষরণে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সংশ্লষিত হরমোন ভাল কাজ দেয়।
২. ডিম্বনালির ক্ষত (Damage to the oviducts) : প্রায় ৩৫% নারীর প্রজননিক সমস্যা হিসেবে ডিম্বনালির পরমণজনিত বা এন্ডোমেট্রিওসিস (endometriosis) নামক অবস্থার কারণকে দায়ী করা হয়। এসব সমস্যার কারণে মিনালি পথে ডিম্বাণু ডিম্বাশয় থেকে জরায়ুতে বহন করতে পারে না।
৩. জরায়ুর ক্ষত (Uterus damage): প্রায় ৫-১০% নারী জরায়ু ক্ষতজনিত সমস্যার কারণে প্রজননিক জটিলতায় ভোগে। এমন ক্ষেত্রে গর্ভধারণ সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে গর্ভাবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা কিংবা গর্ভপাত ঠেকানো। জরায়ুতে ছোট-বড় টিউমার হলে শল্য চিকিৎসায় সাড়ানো যায়। গর্ভনিরোধক দ্রব্যাদি ব্যবহারে ভাল কাজ করে। কখনওবা জন্মগতভাবে বিকৃত গড়নের জরায়ু দেখা যায় ।
৪. সার্ভিক্স বা জরায়ু গ্রীবার ক্ষত (Cervix damage) : গর্ভপাতের কারণে কিংবা সন্তান জন্মদানকালে সার্ভিক্সে ক্ষত সৃষ্টি হতে পারে। ক্ষতের টিস্যু সার্ভিক্সকে সংকীর্ণ করে দেয়, মিউকাস ক্ষরণ বন্ধ করে দিতে পারে। সার্ভিক্সের মিউকাসের মাধ্যমে জরায়ুতে শুক্রাণু সহজে পৌঁছাতে পারে। সার্ভিক্স বেশি প্রশস্ত হলে তিন মাস বয়সি ভ্রূণ গর্ভপাতের শিকার হতে পারে।
৫. শুক্রাণুর প্রতি অ্যান্টিবডি (Antibodies to sperm) : কিছু দুর্লভ ক্ষেত্রে নারী তার স্বামীর শুক্রাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি উৎপন্ন করে। জরায়ু, সার্ভিক্স (জরায়ু গ্রীবা) ও ডিম্বনালিতে এগুলো পাওয়া যায়। ওষুধ প্রয়োগে অনাক্রম্যতন্ত্র দমিয়ে রেখে সমস্যার সমাধান করতে পারলেও আইভিএফ (IVF) সবচেয়ে ভালো পন্থা বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন ।
কোনো গর্ভনিরোধক পদার্থ বা পদ্ধতি ব্যবহার না করে এক বছর নিয়মিত দাম্পত্য জীবন কাটানোর পরও যদি কোনো দম্পতি গর্ভধারণে ব্যর্থ হয় তখন তা প্রজনন অক্ষমতা বলে বিবেচিত হবে। দম্পতির পুরুষ সঙ্গী, নারী সঙ্গী কিংবা উভয়েই প্রজননিক সমস্যায় ভুগতে পারে। অর্থাৎ তারা অনুর্বর (infertile)। অনুর্বর বলতে বোঝায়, দম্পতির সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা কম। তার মানে এ নয় যে তারা সন্তান উৎপাদনে অক্ষম বা বন্ধ্যা (sterile)। বন্ধা বা বন্ধ্যা যাই বলি না কেন তারা কোনদিন সন্তান উৎপাদনে সক্ষম হবে না, কিন্তু অনুর্বর ব্যক্তি-দম্পতি চিকিৎসার কল্যাণে গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদানে সক্ষম। পৃথিবীর ১৫% দম্পতি অনুর্বর (infertile) কিন্তু মাত্র ১-২% দম্পতি বন্ধ্যা বা বন্ধ্য (sterile)।
নারীর প্রজনন হরমোনের ভারসাম্যহীনতা
ডিম্বাশয় থেকে অনেক হরমোন ক্ষরিত হয় । তার মধ্যে এস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরণ ও অ্যান্ড্রোজেন প্রধান। এসব হরমোনের ক্ষরণের মাত্রা কম-বেশি হলে স্বভাবতই ভারসাম্যহীনতা দেখা দেবে। নিচে এ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।
এস্ট্রোজেন সংক্রান্ত ভারসাম্যহীনতা
উচ্চমাত্রার এস্ট্রোজেন : ৩৫ বছরের বেশি বয়স্ক নারীর দেহে উচ্চ মাত্রার এস্ট্রোজেন থাকে। এ সংক্রান্ত জটিলতাকে বয়স ও রজঃচক্রজনিত স্বাভাবিক সমস্যা হিসেবে মেনে নিয়ে নারীরা দিন কাটায়। উচ্চমাত্রার এস্ট্রোজেনের ফলে যে সব লক্ষণ প্রকাশ পায় তার মধ্যে রয়েছে প্রাক-রজঃচক্রীয় সিন্ড্রোম (pre-menstrual syndrome, PMS)। এর ফলে স্তন ফুলে যায়, স্পর্শকাতর ও ব্যথাকাতর হয়; শরীরে পানি জমে, ওজন বেড়ে যায়; ব্রণ উঠে, স্তনবৃন্ত থেকে স্রাব নির্গত হয়;ভালো ঘুম হয় না, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়; দুর্বল লাগে; মাথা ব্যথা, মাইগ্রেন, স্তনব্যথা, পিঠের নিচে ব্যথা হয়; মিষ্টি ও নোনতা খাবারের জন্য ব্যকুল হয়ে পড়ে; আত্মীয় ও বন্ধুদের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে; কোনো কাজে মন বসে না; স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে; সহবাসে অনাগ্রহ জন্মে, কিংবা গর্ভপাতও হতে পারে।
নিম্নমাত্রার এস্ট্রোজেন রজঃনিবৃত্তকালে নিম্নমাত্রার এস্ট্রোজেন থাকা স্বাভাবিক। তবে কারও জরায়ু অপসারিত হলে, কেমোথেরাপি বা বিকিরণ থেরাপির সম্মুখীন হলে তাদের শরীরেও এস্ট্রোজেনের মাত্রা কমে যায়। এস্ট্রোজেন মাত্রা হলে যোনিদেশের চারপাশের প্রাচীর পাতলা হয়ে শুকিয়ে যায় যে কারণে সহবাস কষ্টদায়ক হয়। এর ফলে হস্তরেখার প্রাচীরও পাতলা হয়ে সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। তা ছাড়া, অবসাদ, রাতে ঘাম হওয়া, মনোযোগে বিঘ্ন ঘটা সন্ধিব্যথা, ত্বক শুষ্ক হওয়া, মাথাব্যথা, মাইগ্রেন, আতংকগ্রস্ত থাকা ইত্যাদিও কম এস্ট্রোজেনের কুফল।
প্রোজেস্টেরণ সংক্রান্ত ভারসাম্যহীনতা
উচ্চমাত্রার প্রোজেস্টেরণ : প্রোজেস্টেরণ সাধারণত রজঃচক্রকালে ক্ষরিত হয়। যারা জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ব্যবহার করে তাদের দেহে এ হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। অবসাদ ও যন্ত্রণাহরণকারী ওষুধ সেবনেও প্রোজেস্টেরণের মাত্রা বেড়ে যায় রজঃস্রাবের পরিমাণ কমে যায় এবং ইউরেথ্রার প্রাচীরে প্রভাব বিস্তার করে। দেহে উচ্চমাত্রার প্রোজেস্টেরণের লক্ষণ হচ্ছে- বুকে ব্যথাপ্রবণতা ও স্ফীত হওয়া, অস্থির মেজাজ, অতিরিক্ত ঘুমভাব, কার্যকর এস্ট্রোজেন স্বল্পতা ইত্যাদি।
নিম্নমাত্রার প্রোজেস্ট্রেরণ : নারীদেহে প্রোজেস্টেরণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হরমোনের একটি। দেহের অনেক সূক্ষ্ণ কাজের উদ্দীপক ও নিয়ন্ত্রক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। এটি অন্যতম মৌলিক হরমোন যা প্রয়োজনে এস্ট্রোজেন ও কটিসোন উৎপন্ন করে। দেহে নিম্নমাত্রার প্রোজেস্ট্রেরণের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে- অনুর্বরতা, পিত্তথলির অসুখ, অনিয়মিত রজঃচক্র, রজঃচক্রের সময় রক্তজমাট, স্তনব্যথা, শুষ্ক যোনিদেশ, কম ব্লাড-শ্যুগার, অবসাদ, ম্যাগনেসিয়াম স্বল্পতা প্রভৃতি।
অ্যান্ড্রোজেন সংক্রান্ত ভারসাম্যহীনতা
উচ্চমাত্রার অ্যান্ড্রোজেন : নারীদেহে অ্যান্ড্রোজেনের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে প্রয়োজনে এস্ট্রোজেন নামক স্ত্রীহরমোনে পরিবর্তিত হওয়া। এসব হরমোন রজঃনিবৃত্তির আগে, সময়কালীন ও পরবর্তী সময় জননতন্ত্র, অস্থি, বৃক্ক, যকৃত ও পেশিসহ দেহের অন্যান্য অঙ্গ ও সেগুলোর কাজকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। যৌন উত্তেজনা ও মিলনেও অ্যান্ড্রোজেন প্রভাব বিস্তার করে। দেহে উচ্চমাত্রার অ্যান্ড্রোজেন উপস্থিতির প্রধান লক্ষণ হচ্ছে- অনুর্বরতা, রজঃচক্র অনিয়মিত হওয়া বা একেবারে না হওয়া, পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (polycystic ovary syndrome, PCOS), অস্বাভাবিক স্থান লোমশ হওয়া (যেমন- মুখমন্ডল, ঠোঁট প্রভৃতি জায়গায়), চুল কমে যাওয়া, ব্রণ দেখা দেওয়া, ভাল কোলেস্টেরল কমে যাওয়া, খারাপ কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া, উদরের চতুর্দিক ঘিরে চর্বির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া প্রভৃতি।
নিম্নমাত্রার অ্যান্ড্রোজেন নিম্নমাত্রার অ্যান্ড্রোজেনে সব বয়সের নারীরা বিভিন্ন জটিলতায় ভুগতে পারে। তবে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে প্রাকরজঃনিবৃত্ত ও রজঃনিবৃত্তকালীন নারী । এ সময় পিটুইটারী গ্রন্থিতে টিউমার দেখা দিতে পারে এবং হাড়ের ক্ষয় হতে পারে। অবসাদ, উত্তেজনা হ্রাস, ভাল মন্দের বাছবিচার থাকে না, যোনিদেশে শুষ্কতা প্রভৃতি নিম্নমাত্রার অ্যান্ড্রোজেনসংক্রান্ত জটিলতার লক্ষণ।
পুরুষে প্রজনন হরমোনের ভারসাম্যহীনতাঃ
টেস্টোস্টেরণ পুরুষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হরমোন। জননক্ষম পুরুষে এটি নিয়মিত শুক্রাশয়ে উৎপন্ন ও রক্তস্রোতে প্রবাহিত হয়ে দেহ সুস্থ রাখে। এ হরমোন পুরুষে গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্যের (পেশল দেহ, দাড়ি-গোঁফের প্রকাশ, কন্ঠ পুরু ও স্বর গভীর করে তোলে, যৌনাঙ্গ সুগঠিত ও বড় করে) প্রকাশ ঘটায় । এ হরমোন যৌন উদ্দীপনাকে তাড়িত করে এবং FSH (Follicle Stimulating Hormone)-এর সহযোগিতায় শুক্রাণু সৃষ্টিতে উদ্দীপনা যোগায়। বয়স্ক পুরুষে যাদের যৌনশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে, কিছু গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্যের বিলোপ ঘটে তারা হরমোন প্রতিস্থাপনার মাধ্যমে পুনর্যৌবন ফিরে পেতে চায় কিন্তু এতে হিতে বিপরীত ফল হয়, প্রস্টেট গ্রন্থির ক্যান্সার ও অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস-এর সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যোয়।
সাধারণত বয়স বাড়ার সাথে সাথে পুরুষে টেস্টোস্টেরণের ভারসাম্যহীনতা প্রকট হয়ে উঠে । গড়ে ৪০-৫০ বছরের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা নিচে বর্ণিত লক্ষণগুলোর মাধ্যমে স্পষ্ট হতে থাকে ।
১. অবসাদগ্রস্ত ও দুর্বল অনুভব : এ লক্ষণ নানাভাবে প্রকাশ হতে পারে, যেমন- খাওয়ার পর ক্লান্তিবোধ, স্বাভাবিকের চেয়ে কম কাজ করতে পারা, সারাদিনের সামগ্রিক কাজের পারফরমেন্স নিচুমাত্রার এবং সারাদিন অবসাদগ্রস্ত থাকা। তা ছাড়া, মিলন আকাঙ্খা কমে যাওয়া, ঘাম হওয়া, গায়ে ব্যথা হওয়া, যৌনাঙ্গ কর্মক্ষম না হওয়া প্রভৃতিও টেস্টোস্টেরণ হরমোনের ভারসাম্যহীনতার ফল ।
২. অকালে বুড়িয়ে যাওয়া : দৈহিক ও মানসিকভাবে বুড়িয়ে যাওয়া এ হরমোনের ভারসাম্যহীনতার ফল। চুল পাতলা বা ধূসর হয়ে যাওয়া, হাড়ের ঘনত্ব ও চামড়ার ঔজ্জ্বল্য কমে যাওয়া, কোমড়ে চর্বি জমা, স্মরণ শক্তি কমে যাওয়া, ঘুম না হওয়া প্রভৃতি এ হরমোনের ভারসাম্যহীনতার ফলে ঘটে।
৩. অসুখিভাব : টেস্টোস্টেরণ হরমোনের ভারসাম্যহীনতায় নিজের প্রতি বিশ্বাস ও সম্মানবোধ কমে যায় । দুশ্চিন্তা, স্নায়ুদৌর্বল্য বেড়ে যাওয়া, বিষণ্নতায় ভোগা, কোনো ধরনের উদ্যোগ বা প্রতিযোগিতাহীনতার প্রকাশ, উত্তেজিত হয়ে উঠা প্রভৃতি দেখা দিতে পারে।
৪. যৌন উত্তেজনা কমে যাওয়া : টেস্টোস্টেরণের ভারসাম্যহীনতায় যৌন উত্তেজনা কমতে কমতে একেবারে কমে যায়। এমনকি যৌনাঙ্গ উত্থানেও অক্ষম হয়ে পড়ে। পুরুষে টেস্টোস্টেরণের স্বাভাবিক মাত্রা হচ্ছে ৩৫০-১২৩০ ন্যানোগ্রাম। এক ন্যানোগ্রাম = এক গ্রামের ১০০ কোটি ভাগের ১ ভাগ)। এভাবে টেস্টোস্টেরণ হরমোনের অভাবে যৌন উত্তেজনা হ্রাস, যৌনাকাঙ্খার অনুপস্থিতি ও পৌরষত্বের প্রকাশহীনতাকে অ্যান্ড্রোপজ (andropause) বলে।
অ্যান্ডোপজকে নারীর মেনোপজ (menopause) এর সঙ্গে তুলনা করা হয়।
ভ্রূণের বৃদ্ধির সময় সমস্যা (Problems during Foetal Development):
ভ্রূণের বৃদ্ধি ও সন্তান ভূমিষ্ঠের ক্ষেত্রে উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। ভ্রূণের বৃদ্ধি ও সঠিক জন্মদানের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৯৭% সফল বলে দাবী করেছে CDC (2011)। সমস্ত বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে একটি সুস্থ সবল শিশুর জন্মদানে কতখানি সর্তক থাকতে হয় সে বিষয়ে সাধারণ ধারণা অর্জনের জন্য এখানে ভ্রূণের বৃদ্ধির সময় কী কী সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় এবং সাম্প্রতিককালে এসব সমস্যার মোকাবিলার উপায় সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।
ভ্রূণের বৃদ্ধিকালীন সমস্যা অন্তহীন। সমস্ত সমস্যাকে আলোচনার সুবিধার জন্য প্রধান দুটি ভাগে ভাগ করা হয় :
ক. জিনগত ও ক্রোমোজোমগত সমস্যা (Genetic and Chromosomal problems):
প্রকট ও প্রচ্ছন্ন জিনের কারণে জন্মের শুরুতেই সমস্যার সূত্রপাত ঘটে। অটোসোমের মধ্যে অবস্থিত জিনগুলো অটোসোমল ব্যাধি (autosomal disorder)-র সৃষ্টি করে X-ক্রোমোজোমে অবস্থিত জিনগুলোর কর্মকান্ড দেখা দেয় সেক্স-লিংকড রোগব্যাধি । নিচে কয়েকটি ব্যাধির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো ।
১. অটোসোমাল ব্যাধি (Autosomal disorder) : অধিকাংশ প্রচ্ছন্ন অটোসোমাল রোগের বিকাশ ভূণে হলেও প্রকাশ ঘটে জন্মের ঠিক পর মুহর্তে বা শিশু বয়সে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দশ হাজার শিশুর মধ্যে একজনে এমন একটি অসুখ দেখা যায় যা একটি প্রচ্ছন্ন জিনের কারণে হয়ে থাকে। এ জিনের প্রভাবে শিশু ফিনাইলঅ্যালানিন (phenylalanine) নামক অ্যামিনো এসিড হজম করতে পারে না। এ কারণে মস্তিষ্কে বিষাক্ত পদার্থ জমা হয়ে শিশুকে মানসিক প্রতিবন্ধিতে পরিণত করে। এ অসুখের নাম ফিনাইলকিটোনিউরিয়া (Phenylketonuria)। প্রকট জিনের ব্যাধি হিসেবে হ্যান্টিংটন-স ব্যাধি (Huntington’s disease) বিখ্যাত। এ রোগ আবার শিশু পূর্ণবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত প্রকাশ পায় না। এতে মস্তিষ্কের অবনতি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে মানসিক ও স্নায়বিক বৈকল্য ত্বরান্বিত হয়। রোগ শনাক্তের জন্য আগে শিশুকে পূর্ণবয়স্ক হতে হতো, এখন রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে আরো আগেই শনাক্ত করা যায় ।
২. সেক্স-লিংকড ব্যাধি (Sex-linked disorder) : লাল-সবুজ বর্ণান্ধতা ও হিমোফিলিয়া এ দুটি অতিপরিচিত সেক্স-লিংকড ব্যাধি। প্রচ্ছন্ন জিনের কারণে এ অসুখ হয়। আরেকটি অসুখ আছে তার নাম ফ্র্যাজাইল-X সিন্ড্রোম (Fragile-X Syndrome)। প্রতি চার হাজার পুরুষের একজন আর প্রতি আট হাজার নারীর একজন এ অসুখে ভোগে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি X ক্রেমোজোমে ভঙ্গুর বা ক্ষতিগ্রস্ত একটি জায়গা আছে। শিশুর বয়স যতো বাড়ে অন্যদের সঙ্গে ঘনিষ্টতার মাত্রা ততো কমে যায়। কারণ এটি মানসিক প্রতিবন্ধীগত এবং অটিজম (autism)–এর সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কিত রোগ।
৩. ট্রাইসোমি (Trisomy) : এটি ক্রোমোজোমঘটিত অন্যতম রোগ। ক্রোমোজোমের বিশৃঙ্খল আচরণে অর্ধশতাধিক অসুখে মানুষ ভোগে এবং এসব রোগের অধিকাংশের প্রতিক্রিয়ার ফলে গর্ভপাত ঘটে থাকে। ট্রাইসোমি ট্রাইসোমি এমন এক অবস্থা যখন ভুক্তভোগী নির্দিষ্ট অটোসোমের ৩ কপি বহন করে। যেমন সবচেয়ে পরিচিত ডাউন সিন্ড্রোম (একে ট্রাইসোমি 21-ও বলে)। এ ক্ষেত্রে শিশুদেহে ক্রোমোজোম ২১-এর তিনটি কপি থাকে । এ ধরনের জটিলতা নিয়ে ৮০০-১০০০ শিশুর মধ্যে ১ জন শিশু জন্মগ্রহণ করে। বিশেষ আকৃতির চোখ, মুখ ও গাল, সে সঙ্গে মস্তিষ্কের ছোট আকৃতি, হৃদরোগ প্রভৃতি জটিলতা নিয়ে চরম মানসিক প্রতিবন্ধী হিসেবে শিশু জন্ম নেয়, বেড়ে উঠে।
খ) টেরাটোজেন (Teratogens): জনিত সমস্যা
সফল গর্ভধারণই সুস্থ শিশুর জন্মদানের একমাত্র উপায় নয় । ভ্রূণের বৃদ্ধি কোন পরিবেশে হচ্ছে সে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা উচিত। মনে রাখতে হবে, ভ্ৰূণ এমন কোনো অবস্থায় থাকে না যা পরিবেশের আওতার বাইরে। এ কারণে, দূষিত বহিঃপরিবেশ, মায়ের অসুস্থতা ও ওষুধ গ্রহণ কিংবা মাদক সেবন সবকিছুতে ভ্রূণের বৃদ্ধি প্রভাবিত হয়। ভ্রূণ বৃদ্ধির প্রায় শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ ৬-৮ সপ্তাহের মধ্যে যখন এটি বিভিন্ন অঙ্গন্ত্রে সজ্জিত ফিটাসে পরিণত হবে সে সময়কালটি সবচেয়ে বেশি বিপদসংকুল । তখন বিভিন্ন পরিবেশিক কারণে অঙ্গবিকৃতি বা অঙ্গহানি ঘটে। এ সব বিকৃতি বা হানির জন্য যে কারণগুলো দায়ী সেগুলোই হচ্ছে টেরাটোজেন । নিচে কতকগুলো টেরাটোজেন ও মানবভূণে তার কুফল আলোচনা করা হলো।
১. রুবেলা / জার্মান হাম (Rubella / German Measles) : ভূণাবস্থায় রুবেলা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে জ্বণের গর্ভপাত ঘটে কিংবা ভূমিষ্ঠ হলেও অন্ধ, বধির, মানসিক প্রতিবন্ধী, হৃৎপিন্ড ও স্নায়ুতন্ত্রে ত্রুটি নিয়ে জন্মায়।
২. HIV ও হেপাটাইটিস B : এ ধরনের ভাইরাসে আক্রান্ত মাতৃদেহে বর্ধনশীল ভুণ জন্মগত অঙ্গবিকৃতি নিয়ে। জন্মগ্রহণ করে না, বরং জীবনহরণকারী সংক্রমণ হিসেবে পরিচিত।
৩. সাইটোমেগালোভাইরাস (Cytomegalovirus, CMV): এটি হারপিস গ্রুপভুক্ত ভাইরাস। পূর্ণবয়স্ক মানুষে এ ভাইরাস কোনো উপসর্গ বা লক্ষণ প্রকাশ করে না বলে এর উপস্থিতি সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না। কিন্তু সন্তান জন্মগত পঙ্গু হয়ে জন্মায়। সিফিলিসের সংক্রমণে শিশু চোখ, কান ও মস্তিষ্কের খুঁত নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয় ।
৪. দীর্ঘকালীন অসুস্থতা (Chronic illness) : হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ও লুপাস (lupus) নামে চর্মক্ষত বো পরিস্ফুটনে প্রভাব ফেলে। ডায়াবেটিস আক্রান্ত মা’দের বিপাকীয় তারতম্যের কারণে যেভাবে রক্তে চিনির ঘটে এবং তার মাত্রা সঠিক রাখতে সুচিন্তিত ব্যবস্থা না নিলে দূণের স্নায়ুতন্ত্র মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৫. ধূমপান (Smoking) : ধূমপায়ী মায়ের ভ্রূণবৃদ্ধিকালীন সময়ে মারাত্মক পুষ্টি সংকটে ভোগে নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে। তামাক (সিগারেট) জাতীয় দ্রব্যাদির প্রধান উপাদান নিকোটিন । নিকোটিন বাস সংকুচিত করে দেয় ফলে অমরায় রক্ত প্রবাহ ও পুষ্টি পদার্থের পরিমাণ কমে যায়, ভ্রূণের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়.
৬. মদপান (Drinking) : বর্ধনশীল ভ্রূণকে গর্ভে ধারণ করে অবাধে মদপান করলে ভূমিষ্ঠ শিশু যে অসুখে ভোগ তার ফিটাল অ্যালকোহল সিন্ড্রোম (Foetal Alcohol Syndrome, সংক্ষেপে FAS)। যে মায়েরা অতিরিক্ত মদ্যপায়ী বা অ্যালকোহলিক তাদের গর্ভস্থ ভ্রূণযে সব ক্ষতির সম্মুখীন হয় তার প্রকাশ ঘটে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর।
৭. খাদ্যগ্রহণ (Eating) : গর্ভবতী মায়ের খাদ্য গ্রহণের বিষয়টি সারা পৃথিবীতে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়. শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই অন্ততঃ এ বিষয়ে সজাগ যে ভ্রূণের স্বাভাবিক ও সুস্থ বৃদ্ধির জন্য পুষ্টিকর ও বাড়তি খাবার প্রয়োজন। গবেষণার আলোকে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে ভ্রূণের বৃদ্ধির সময় নিউরাল নালির পরিস্ফুটনে ফলিক এসিড খাদ্য গ্রহণ একান্ত প্রয়োজন। কোনো নারীর গর্ভসঞ্চার হয়েছে কিংবা তা জানার আগেই ভ্রূণের নিউরাল নালির পরিস্ফূটন শুরু হয়ে যায়। অতএব, আহারের বাছ-বিচার অত্যন্ত জরুরী।
৮. মানসিক অবস্থা (Mental state) : ভ্রূণের বৃদ্ধিকালীন সময়কালটি বাংলাদেশের ধনী-গরীব সব পরিবারই সচেষ্ট থাকে যেন মা ও শিশু সুস্থ থাকে। পরিবারে বয়স্ক সদস্যের নির্দেশও থাকে যেন মায়ের মন সবসময় আনন্দে থাকে । আধুনিক যান্ত্রিক যুগেও এটি প্রমাণিত হয়েছে যে প্রফুল্ল থাকা মায়ের ভ্রূণযেভাবে বর্ধিত হয় বিষন্ন মায়ের ভ্রূণ তেমনটি হয় না ।
সিলিফিসঃ Treponema pallidum নামক ব্যাকটেরিয়ামের সংক্রমণে সৃষ্ট যৌনবাহিত রোগকে সিফিলিস বলে । এ রোগে পরে দীর্ঘকালীন জটিলতা দেখা দেয় এবং সঠিক চিকিৎসা না করালে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে।
সংক্রমণ প্রক্রিয়া (Mode of Transmission):
সিফিলিস আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে সৃষ্ট সিফিলিটিক ক্ষত (siphilitic sore)-এর সরাসরি সংস্পর্শে এলে জনান্তরে এ রাগ ছড়িয়ে পড়ে। সিফিলিটিক ক্ষত প্রধানত বহিযৌনাঙ্গ, যোনি, পায়ু বা মলাশয়ে অবস্থান করে, কিছু দেখা যায় ঠোঁট,মুখে। যৌনমিলনের ধরনের উপর (যোনি, পায়ু, মুখ) সংক্রমণের উৎস নির্ভর করে। সিফিলিসে আক্রান্ত গর্ভবর্তী সুহিলা সন্তান ভূমিষ্ঠের আগেই তার শরীরে সিফিলিস রোগের বিস্তার ঘটিয়ে দেয়। সিফিলিসের জীবাণুতে সংক্রমিত হলে সাধারণত ২১ দিনের মাথায় রোগের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে, তবে ব্যক্তি বিশেষে সময়কাল ১০-৯০ দিন হতে পারে
লক্ষনঃ প্রথম লক্ষণ যেমন বেশ দেরিতে (অর্থাৎ ২১ দিন পর) প্রকাশ পায় তেমনি শেষ পর্যায়ে যেতেও অনেক সপ্তাহ, মাস বা বছর পেরিয়ে যায়। লক্ষণ প্রকাশের সময়কালকে ৪টি পর্যায়ে ভাগ করা হয়।
১. প্রাথমিক পর্যায় (Primary stage) : ২১ দিন পর ১টি মাত্র সিফিলিটিক ক্ষত প্রকাশিত হয়। এটি দৃঢ়, গোল ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ধাবিত হয়। ব্যথাহীন ক্ষত। এটি দেখে বোঝা যায় জীবাণু কোন পথে সংক্রমিত হয়েছে। তিন থেকে ছয় সপ্তাহ পর ক্ষতপূরণ হয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে ধাবিত হয়।
২. মাধ্যমিক পর্যায় (Secondary Stage) : গায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফুসকুড়ি (rash) দেখা দেওয়া এবং সিফিলিটিক ক্ষত অমসৃণ, লাল বা লালচে বাদামী দাগ হিসেবে হাত-পায়ের তালুতে আবির্ভূত হওয়া এ পর্যায়ের লক্ষণ। ক্ষত ছাড়াও জ্বর, ক্ষীত লসিকা গ্রন্থি, গলাভাঙ্গা, বিভিন্ন জায়গায় চুল উঠে যাওয়া, মাথাব্যথা, ওজন কমে যাওয়া, পেশিব্যথা, ক্লান্তি প্রভৃতিও এ পর্যায়ে দেখা দেয়।
৩. সুপ্ত পর্যায় (Latent stage) : প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের লক্ষণগুলো অদৃশ্য হলে শুরু হয় সুপ্ত পর্যায়। এ সময় আক্রান্তের দেহে কোনো ক্ষত, ফুসকুড়ি বা অন্যান্য লক্ষণ দেখা যায় না। বছরের পর বছর এ পর্যায় অব্যাহত থাকতে পারে।
৪. বিলম্বিত পর্যায় (Late stage) : জীবাণুতে প্রথম সংক্রমিত হওয়ার প্রায় ১০-২০ বছর পর সিফিলিস পূর্ণাঙ্গরূপে আবির্ভূত হয় । রোগের বিলম্বিত দশায় রোগীর মস্তিষ্ক, স্নায়ু, চোখ, হৃৎপিন্ড, রক্তকণিকা, যকৃত, গ্রন্থি ও সন্ধির ক্ষতি সাধন ভ করে। ফলে পেশি সঞ্চালনে বিঘ্ন ঘটে, দেখা দেয় পঙ্গুত্ব, অন্ধত্ব, হতবুদ্ধি ও অস্থিরচিত্ত। এ অবস্থায় মানুষের মৃত্যু ঘটে ।
প্রতিকার (Remedy)
প্রতিরোধ : সিফিলিসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে স্থায়ী সঙ্গীর সঙ্গে জীবনযাপন করা ভিন্ন সঙ্গীর কথা চিন্তাই করা উচিৎ নয় । কিংবা কোথাও সিফিলিস রোগী আছে এমন ঘরে যাওয়া-আসা করাও নিরাপদ নয়। তা ছাড়া, অ্যালকোহল ও মাদক জাতীয় দ্রব্য থেকে দূরে থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়, কারণ এসব পান বা সেবন যৌন পর আচরণকে উসকে দেয়, তখন সঙ্গী নির্বাচন সঠিক নাও হতে পারে।
চিকিৎসা : সিফিলিসের লক্ষণ জানা থাকলে প্রাথমিক পর্যায়ে সহজেই চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়। কারও দেহে প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায় বা প্রাক-সুপ্ত পর্যায়ের সিফিলিস জীবাণু থাকলে তাকে একটি মাত্র Benzathine Pen G ইনজেকশন দিলেই রোগ দূর হতে পারে। সুপ্ত পর্যায়ের শেষ অবস্থায় কেউ থাকলে তাকে প্রতি সপ্তাহে একটি করে ইনজেকশন দিতে হয়। চিকিৎসার ফলে সিফিলিস সারবে কিন্তু দেহের ক্ষতিগ্রস্থ টিস্যুর ক্ষত পূরণ হবে না। সম্পূর্ণ না সারা পর্যন্ত যৌন মিলন থেকে নিজেকে বা অন্যকে বিরত রাখতে হবে।
গনোরিয়াঃ Neisseria gonorrhoeae প্রজাতিভুক্ত ব্যাকটেরিয়ামের সংক্রমণে সৃষ্ট যৌনবাহিত রোগকে গনোরিয়া বলে ) N gonorrhoeae নারীর জনন নালি (সারভিক্স, জরায়ু, ফেলোপিয়ান নালিসহ) এবং নারী ও পুরুষের ইউরেথ্রার মিউকাস ঝিল্লিতে সংক্রমণ ঘটায় । মুখ, গলা, চোখ ও পায়ুর মিউকাস ঝিল্লিও এ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে আক্রান্ত হয়। গর্ভকালীন জটিলতা ছাড়াও নারী-পুরুষ উভয়ে বন্ধ্যা-বন্ধ্য হয়ে যেতে পারে।
সংক্রমণ প্রক্রিয়া (Mode of Transmission): যৌন মিলনের সময় আক্রান্ত দেহের বহির্যৌনাঙ্গ, মুখ ও পায়ু থেকে সংক্রমণ ঘটে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়ও আক্রান্ত মাতৃদেহ থেকে এ রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। যে ব্যক্তি এক সময় গনোরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসায় সেরে উঠেছে এমন ব্যক্তি গনোরিয়া আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে পুনর্মিলন ঘটালে সেও পুনঃসংক্রমিত হতে পারে। গনোরিয়ায় আক্রান্ত অনেক ব্যক্তির দেহে তেমন স্পষ্ট লক্ষণ প্রকাশ পায় না বলে এটি ব্যাপক বিস্তৃত যৌনবাহিত অসুখ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
লক্ষণ (Symptoms):
নারীদের গনোরিয়ার লক্ষণগুলো হচ্ছে : উদরীয় ব্যথা; দুই রজঃচক্রের মধ্যবর্তী সময়ে প্রচুর যোনিস্রাব ও রক্তপাত; অনিয়মিত রজঃচক্র; জ্বর ও গায়ে ফুসকুড়ি; কষ্টদায়ক যৌনমিলন; কষ্টদায়ক মূত্রত্যাগ; যোনিদেশ ফুলে যাওয়া; স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মূত্রত্যাগের প্রবণতা; হলদে বা হলদে-সবুজ যোনিস্রাব; অস্থিসন্ধিতে ব্যথা প্রভৃতি।
পুরুষের গনোরিয়ার লক্ষণগুলো হচ্ছে : প্রস্রাবে জ্বালা-পোড়া ব্যথা অনুভব; প্রস্রাবের পর চাপ দিলে আঠার মতো পুঁজ বের হয়; স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিবার মূত্রত্যাগের ইচ্ছা; শুক্রাশয় ও অন্ডথলিতে ব্যথা প্রভৃতি। পুরুষে এসব লক্ষণগুলো শুধু সকালে, তাও হালকা অনুভূত হয় বলে অনেকে বুঝতেই পারে না যে, সে গনোরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে।
গনোরিয়ায় আক্রান্ত পুরুষ ও নারী উভয় দেহে মলাশয় থেকে স্রাব, পায়ুপথে চুলকানি, ক্ষত, রক্তপাত, মলত্যাগে প্রচন্ড ব্যথা প্রভৃতি লক্ষণ দেখা দেয়। তা ছাড়া, গলবিল সংক্রমিত হলে গলাভাঙ্গা-র উদ্ভব ঘটে।
প্রতিকার (Remedy): সামান্য সতর্কতা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্বন্ধে জ্ঞান রাখলে গনোরিয়ার মতো মারাত্মক যৌনবাহিত রোগ থেকে নিজেকে ও ভবিষ্যৎ বংশধরকে নিরাপত্তা দেওয়া খুব সহজ। এ জন্যে যা করা দরকার তা হচ্ছে ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে দিয়ে কম বয়সী ও গর্ভবতী নারীদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করাতে হবে; যৌনসঙ্গী নির্বাচনে অবশ্যই সতর্ক ও নিশ্চিত থাকতে হবে; চিকিৎসকের প্রেসক্রিপসন অনুযায়ী ওষুধ খেতে বা লাগাতে হবে; নিরোগ না হওয়া পর্যন্ত মিলনে প্রবৃত্ত না হওয়া। প্রতিবার মিলনকালে কনডম ব্যবহার করা ইত্যাদি।
এইডস (Acquired Immune Deficiency Syndrome বা AIDS) :
বর্তমান বিশ্বে এইডস একটি মারাত্মক ঘাতক ব্যাধি হিসেবে পরিচিত। 1981 সালে রোগটি আবিষ্কৃত হয়। Acquired Immune Deficiency Syndrome-এর শব্দগুলোর আদ্যক্ষর দিয়ে এ রোগটির নামকরণ (AIDS) করা হয়েছে। UNAIDS-এর এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় যে সারা বিশ্বে বর্তমানে 2 কোটি 30 লাখের বেশি লোক AIDS-এর জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত। এর মধ্যে প্রায় 40 শতাংশ হলো নারী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রায় 164 টি দেশে এই রোগের বিস্তার ঘটেছে। Human Immune Deficiency Virus সংক্ষেপে HIV ভাইরাসের আক্রমণে এইডস হয়। এই ভাইরাস শ্বেত রক্ত কোষের ক্ষতিসাধন করে এবং এ কোষের এন্টিবডি তৈরিসহ রোগ প্রতিরোধ-সংক্রান্ত কাজে বিঘ্ন ঘটায়। ফলে শ্বেত রক্ত কোষের সংখ্যা বিশেষ করে CD4 জাতীয় শ্বেত রক্তকোষ) ও এন্টিবডির পরিমাণ ক্রমশ কমতে থাকে। এই ভাইরাস মানবদেহে সুপ্ত অবস্থায় অনেক দিন থাকতে পারে। এই রোগীর দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিনষ্ট হয়ে যায় বলে রোগীর মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়ে। কারণ এইডস রোগীর রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করার মতো কোনো ঔষধ এখনও আবিষ্কার হয়নি।
এইডস রোগের কারন (The cause of AIDS):
নিম্নলিখিত কারণে একজন সুস্থ ব্যক্তি এই ঘাতক রোগ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন,
(i) এইডস আক্রান্ত পুরুষ বা মহিলার সাথে অনিরাপদ যৌনমিলনের মাধ্যমে এ রোগ হয়।
ii) দুর্ঘটনাজনিত রক্তক্ষরণ, প্রসবজনিত রক্তক্ষরণ, বড় অস্ত্রোপচার, রক্তশূন্যতা, থ্যালাসেমিয়া, ক্যান্সার ইত্যাদি ক্ষেত্রে দেহে রক্ত পরিসঞ্চালন প্রয়োজন হয়। এ অবস্থায় এইডস ফসফোলিপিড লেয়ার রোগে আক্রান্ত রোগীর রক্ত সুস্থ ব্যক্তির দেহে সঞ্চালন করলে এইডস রোগ হয়।
(iii) এইডসে আক্রান্ত বাবা থেকে সরাসরি সন্তানে রোগটি ছড়ায় না। বাবার সাথে যৌনমিলনের মাধ্যমে মায়ের এইডস হতে পারে এবং আক্রান্ত মায়ের গর্ভের সন্তান তখন এইডস রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত মায়ের দুধ শিশু পান করলে সে শিশুও এইডসে আক্রান্ত হতে পারে।
(iv) HIV জীবাণুযুক্ত ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, সুচ, দন্ত চিকিৎসার যন্ত্রপাতি এবং অপারেশনের যন্ত্রপাতির ব্যবহারের মাধ্যমেও সুস্থ ব্যক্তি এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এমনকি সেলুনে একই ব্লেড একাধিক ব্যক্তি ব্যবহার করলে তার মাধ্যমেও রোগটি ছড়াতে পারে।
(v) এইডসে আক্রান্ত ব্যক্তির কোনো অঙ্গ অন্য ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করলে এ রোগ হয়।
এইডস রোগের লক্ষণ (Symptoms of AIDS)
রোগ জীবাণু সুস্থ দেহে প্রবেশ করার প্রায় 6 মাস পরে এই রোগের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। তখন এর প্রকাশ অত্যন্ত মৃদু থাকে এবং কিছুদিনের মধ্যেই মিলিয়ে যায়। তারপর কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত রোগী আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ থাকে কিন্তু তার দেহের মধ্যে এইডসের ভাইরাস সংখ্যাবৃদ্ধি করতে থাকে। ভাইরাস যথেষ্ট সংখ্যায় বৃদ্ধি পেলে হঠাৎ করেই অসুখ মারাত্মকভাবে ফিরে আসে। তখন আর বেশি কিছু করার থাকে না। এর আগে সেই ব্যক্তি যে এইডস রোগের বাহক তা বোঝা মুশকিল।
এইডসের লক্ষণগুলো হলো:
*দ্রুত রোগীর ওজন কমতে থাকে।
*এক মাসেরও বেশি সময়ব্যাপী একটানা জ্বর থাকে অথবা জ্বর জ্বর ভাব দেখা দেয়।
*এক মাস বা তারও বেশি সময় ধরে পাতলা পায়খানা হয়।
*অনেক দিন ধরে শুকনো কাশি হতে থাকে।
*ঘাড় এবং বগলে ব্যথা অনুভব হয়, মুখমণ্ডল খসখসে হয়ে যায়।
*মুখমণ্ডল, চোখের পাতা, নাক ইত্যাদি অঙ্গ হঠাৎ ফুলে যায় এবং সহজে এই ফোলা কমে না।
*সারা দেহে চুলকানি হয়।
প্রতিরোধ : এইডস প্রতিরোধে নিচে বর্ণিত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
নিরাপদ যৌন সঙ্গম করা এবং ধর্মীয় ও সামাজিক বিধি মেনে চলা। অনিরাপদ যৌন মিলন সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা; যৌন মিলনে কনডমের ব্যবহার এবং এইডস থেকে রক্ষায় এর ভূমিকা সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি কা; এইডস-এর ভয়াবহতা সম্পর্কে রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকা, বিলবোর্ড, পোস্টার ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করা; ইনজেকশন গ্রহণের সময় ব্যবহৃত সিরিঞ্জ পুনরায় ব্যবহার না করা এবং শিরার মাধ্যমে কোন ড্রাগ গ্রহণ না করা; সেলুনে একটি ব্লেড একবারই ব্যবহার করা; সংক্রমিত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে সম্পূর্ণভাবে আলাদা রেখে চিকিৎসা থেকে প্রদান করা; পতিতাদের নিরাপদ যৌনতা সম্পর্কে সচেতন করা; প্রতিবার মিলনকালে কনডম ব্যবহার করা প্রভৃতি।
চিকিৎসা : এইডসের চিকিৎসায় ৩ শ্রেণির ওষুধ প্রয়োগ করা হয় । রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে HIV-র প্রতিলিপিকরণ ঠেকাতে রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেজ এনজাইমাকে বাধা দিতে বৃত্ত Nucleoside analogue Reverse Transcriptase Inhibitors (NRTIS) প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু এ ওষুধে অস্থিমজ্জাসহ শারীরিক অনেক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। Non Nucleoside Reverse Transcriptase Inhibitors (NNRTIS) ওষুধ খেলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে রোগী ওলট-পালট স্বপ্ন দেখে, সবসময় নিদ্রালু থাকে প্রভৃতি।
HIV-র জীবন চক্রের শেষ পর্যায়ে HIV Protease এনজাইমের কাজে বাধা দিতে Protease Inhibitors (PIs) জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। তবে জানা গেছে, HIV সংক্রমণ প্রতিরোধে কোনো ভ্যাক্সিন আজ পর্যন্ত আবষ্কৃিত হয়নি।
তিনটি ভ্রূণীয় স্তরের পরিণতি (Fate of three Germ Layers):
গ্যাস্ট্রুলেশনের ফলে সৃষ্ট এক্টোডার্ম, মেসোডার্ম এবং এন্ডোডার্ম ভ্রূণের গঠন ও বিকাশের যাবতীয় উপাদানের উৎস। নিচে তিনটি ভ্রূণীয় স্তরের পরিণতি উল্লেখ করা হলো।
এক্টোডার্মের পরিণতি : প্রাথমিক পর্যায়ে ভ্রূণের সমগ্রদেহের বাইরের আবরণ গঠিত হয় এক্টোডার্মের কোষ দিয়ে। এক্টোডার্মের এ কোষস্তর মেসোডার্মের মেসেনকাইম কোষের সাথে সম্মিলিতভাবে দেহের ত্বক গঠন করে। ত্বকের এপিডার্মিস গঠিত হয় এক্টোডার্মাল কোষস্তর থেকে। ত্বকোদ্ভূত বিভিন্ন গ্রন্থি, চুল, নখ, পালক, শিশু, ক্ষুর, আইশ এবং চোখের লেন্স ইত্যাদি সৃষ্টি হয় এপিডার্মিস থেকে। পৌষ্টিকনালির অন্তঃপ্রাচীর এক্টোডার্মজাত কোষ দিয়ে আবৃত থাকে। ঠোঁট ও মুখবিবরের আবরণ, বিভিন্ন মৌখিকগ্রন্থি, জিহ্বার আবরণ, পায়ুর অভ্যন্তরীণ আবরণ, ক্লোয়েকার অংশ ইত্যাদিও এক্টোডার্ম থেকেই গঠিত হয়। তা ছাড়া দাঁতের এনামেল, সকল সংবেদী অঙ্গ এবং কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র এক্টোডার্ম থেকে সৃষ্টি হয়।
২. মেসোডার্মের পরিণতি : ভ্রূণ বিকাশের সময় এন্ডোডার্ম থেকে মেসোডার্ম সৃষ্টি হয় এবং এক্টোডার্ম ও এন্ডোডার্মের মাঝখানে অবস্থান করে। ভ্রূণীয় বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে মেসোডার্ম থেকে এপিমিয়ার, মেসোমিয়ার এবং হাইপোমিয়ার নামে তিনটি অংশের উত্তর হয় এবং এরা সুনির্দিষ্ট অঙ্গ গঠন করে। এপিমিয়ারের কিছু অংশ মেসেনকাইমরূপে ত্বকের ডার্মিস এবং কিছু অংশ নটোকর্ড গঠন করে। এপিমিয়ারের বাকী অংশ মায়োটোম গঠন করে যেগুলো থেকে দেহের অধিকাংশ পেশি গঠিত হয়। মেসোমিয়ার গঠন করে রেচন ও জনন অঙ্গ এবং এদের নালিসমূহ। হাইপোমিয়ার প্রাণীর ঐচ্ছিকপেশি, হৃৎপিণ্ড, দেহগহ্বরের অন্তঃআরবণী, পেরিকার্ডিয়াম ইত্যাদি গঠন করে। উপাঙ্গিক কঙ্কাল, যোজক টিস্যু, রক্তকণিকা, রক্তনালি, লসিকা, লসিকানালি, লসিকাগ্রন্থি, চোখের বিভিন্ন অংশ, দাঁতের ডেন্টাইন, বৃক্কের কর্টেক্স, শিং ইত্যাদি গঠিত হয় ভ্রূণের মেসোডার্মের মেসেনকাইম থেকে।
৩. এন্ডোডার্মের পরিণতি : ভ্রূণীয় আর্কেন্টেরণের অন্তঃআবরণী ছাড়া এর সম্পূর্ণ অংশই গঠিত হয় এন্ডোডার্ম থেকে। এখান থেকে গলবিল, গলনালি, পাকস্থলি এবং অস্ত্র গঠনের সাথে সাথে বৃক্ক ও অগ্ন্যাশয়ের আবির্ভাব ঘটে। এসময় গলবিল অঞ্চলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এর পার্শ্বদেশ থেকে কয়েক জোড়া ক্ষুদ্র থলিকা উদ্ভবের মাধ্যমে গঠিত হয় মধ্যকর্ণ, টনসিল, থাইমাস এবং থাইরয়েড ও প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি। স্থলচর মেরুদণ্ডী প্রাণিদের ক্ষেত্রে গলবিলের অঙ্কীয়ভাগের একটি উপবৃদ্ধি থেকে ল্যারিংক্স, ট্রাকিয়া ও ফুসফুসের সৃষ্টি হয়। তাছাড়া মূত্রথলি, মূত্রনালি ও সংশ্লিষ্ট গ্রন্থি সৃষ্টি হয় এন্ডোডার্ম থেকে।
আরও দেখুন...